Tuesday, 20 May 2014

গবাদি পশুর রোগ ও প্রতিকার


প্যারাটিউবারকিউলসিস প্রতিরোধ

প্যারাটিউবারকিউলসিস গরুর একটি ছোঁয়াচে রোগ Mycobacterium paratuberculosis নামের এক জাতীয় ব্যাক্টেরিয়ার কারণে রোগ হয় একেজোনসডিজিসও বলে রোগের ফলে দুগ্ধবতী গাভীর দুধ উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয় রোগে গাভী মারাও যেতে পারে যুক্তরাষ্ট্রে এক হাজার গাভী রয়েছে এমন একটি দুগ্ধ খামার প্যারাটিউবারকিউলসিস রোগের কারণে বছরে প্রায় দুই লাখ ইউএস ডলার ক্ষতির সম্মুখীন হয় আমাদের দেশে ক্ষতির পরিমাণ কত সে বিষয়ে কোনো পরিসংখ্যান না থাকায় সঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না প্যারাটিউবারকিউলসিস রোগে দুগ্ধবতী গাভীর দুধ উৎপাদন কমে যাওয়া ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের লক্ষণ দেখা যায় দীর্ঘস্থায়ী এবং ভয়ংকর ডায়রিয়া তার মধ্যে অন্যতম ডায়রিয়ায় পানি প্রয়োজনীয় খনিজ লবণ হারানোর কারণে গরুর শরীর শুকিয়ে যায়, ওজন কমে যায় এবং চামড়া রুক্ষ হয়ে যায় কয়েক সপ্তাহ পর চোয়ালের নীচে ফুলে উঠে দেখে মনে হয় বোতল জাতীয় কিছু মুখে রেখে হয়ত মুখ বন্ধ করে আছে তাই একেবটল জোবলে প্রোটিন ঘাটতির কারণে এমনটি হয়ে থাকে প্যারাটিউবারকিউলসিস প্রতিরোধ করা মোটেও সহজ নয় ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণের উৎস কিছুতেই বন্ধ করা যায় না ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণ বন্ধ না করতে পারায় রোগ প্রতিরোধ করাও সম্ভব হয় না তবে প্যারাটিউবারকিউলসিস প্রতিরোধে নতুন উপায়ের কথা শুনিয়েছেন আমেরিকান এগ্রিকালচারাল রিসার্চ সার্ভিসের

 মাইক্রোবায়োলজিস্ট কিম কুক কুক ধারণা করেছিলেন পানির পাত্রই হয়ত খামারে ব্যাক্টেরিয়া সংক্রমণের প্রধান উৎস তাই তিনি পরীক্ষা করে দেখেন পানির পাত্রের ভিন্নতার কারণে ব্যাক্টেরিয়া সংক্রমণে তারতম্য হয় কি না কংক্রিট, প্লাস্টিক, স্টেইনলেস স্টিল এবং গ্যালভানাইজিং স্টিলের বিভিন্ন ট্রাফে (খামারে গবাদি পশুকে পানি সরবরাহ করার পাত্র) সংক্রমিত পানি নিয়ে তাতে ব্যাক্টেরিয়ার সংখ্যা নিরূপণ করেন তিনদিন পর লক্ষ্য করেন ব্যাক্টেরিয়ার সংখ্যা বহুগুণে বেড়ে গেছে তিনি তার পর্যবেক্ষণে দেখেন এসব ব্যাক্টেরিয়া ১৪৯ দিন বেঁচে ছিল কিন্তু স্টেইনলেস স্টিল এবং গ্যালভানাইজিং স্টিলের ট্রাফে ব্যাক্টেরিয়ার বেঁচে থাকার মেয়াদ অনেক কম এরপর তিনি অপর পরীক্ষায় ট্রাফের পানিতে প্রতি সপ্তাহে ১০০ গ্যালন পানির জন্য টেবিল চামচ পরিমাণ হিসেবে ক্লোরিন যোগ করেন এবার আরো বিস্ময়কর ফলাফল লক্ষ্য করেন তিন সপ্তাহ পর দেখেন কংক্রিটের ট্র্যাফেতে ব্যাক্টেরিয়ার পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে ৩৪ শতাংশে, প্লাস্টিকের ট্র্যাফেতে ২০ শতাংশে কিন্তু স্টেইনলেস স্টিল এবং গ্যালভানাইজিং স্টিলে ব্যাক্টেরিয়ার পরিমাণ অবশিষ্ট ছিল শতাংশেরও কম কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, কনক্রিটের উচ্চমাত্রার পিএইচ ক্লোরিনের কর্মক্ষমতা কমিয়ে দেয় ফলে কনক্রিটের ট্রাফেতে ব্যাক্টেরিয়ার পরিমাণ বেশি ছিল প্লাস্টিকের ট্রাফেতে ব্যাক্টেরিয়ার সংখ্যা বেশি থাকার কারণ প্লাস্টিক ক্লোরিন শুষে নেয় ফলে ক্লোরিনের কর্মক্ষমতা অক্ষুন্ন থাকে না কিন্তু স্টেইনলেস স্টিল এবং গ্যালভানাইজিং স্টিলের ট্রাফেতে ক্লোরিনের কর্মক্ষমতা অপরিবর্তিত থাকায় ব্যাক্টেরিয়ার সংখ্যা প্রায় নিমূল হয়ে গিয়েছিল কুক এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, স্টেইনলেস স্টিলের ট্রাফেতে পানি সরবরাহ করা হলে খামারে প্যারাটিউবারকিউলসিসের মাত্রা কমাতে সহায়তা করবে সাথে ক্লোরিন যোগ করা হলে এর মাত্রা বহুলাংশে হ্রাস পাবে তাই খামারে প্যারাটিউবারকিউলিসিস রোগ প্রতিরোধে স্টেইনলেস স্টিলের পাত্রে ক্লোরিন মিশ্রিত খাবার পানি সরবরাহ করার পরামর্শ দিয়েছেন কুক
 লেখক: ডা.হাসান মুহাম্মদ মিনহাজে আউয়াল, ডিভিএম, পিজিটি, জামালপুর




গরুর প্রাণঘাতী রোগ ব্যাবেসিওসিস

জমিলা খাতুন চার বছর হলো দুটি গাভী পালন করছেন গাভীর দুধ বিক্রিই তার আয়ের একমাত্র উৎস দিন ধরে লক্ষ্য করছেন, একটি গাভী ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করছে না কানের গোড়ায় হাত দিয়ে দেখলেন জ্বর জ্বরও লাগছে একদিন দুপুরে দেখলেন গাভীটির প্রস্রাব রক্তের মতো লাল পায়খানাও লালচে ধরনের ভীষণ ভয় পেলেন তিনি কারণ ধরনের অসুখ আগে কখনো কোনো গরুর হয়নি স্খানীয় পশু চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলেন তিনি চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ব্যবস্খাপত্র দিলেন পরদিন থেকেই গাভীটির প্রস্রাব স্বাভাবিক হয়ে এলো এবং কয়েক দিনের মধ্যে পুরোপুরি সুস্খ হয়ে উঠল
 যেকোনো গরুরই ধরনের রোগ হতে পারে, যার নাম ব্যাবেসিওসিস পরজীবীঘটিত একধরনের রোগ Boophilus microplus নামের এক ধরনের উকুনের কামড়ে এই পরজীবী গরুর দেহে প্রবেশ করে রক্তের লোহিত কণিকায় আশ্রয় নেয়, সেখানেই বংশ বৃদ্ধি করে ক্রমেই অন্যান্য লোহিত কণিকায়ও আক্রমণ করে এতে লোহিত কণিকা ভেঙে হিমোগ্লোবিন রক্তে ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রস্রাবের মাধ্যমে বের হয়ে আসে বেশি লোহিত কণিকা আক্রান্ত হলে গরুর রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়

রোগের লক্ষণ : জ্বর হচ্ছে এই রোগের প্রথম লক্ষণ জীবাণু বহনকারী উকুনের কামড়ের প্রায় তিন সপ্তাহের মধ্যেই জ্বর দেখা দেয় গরু ঘন ঘন শ্বাস-প্রশ্বাস নেয় শ্বাস গ্রহণের চেয়ে শ্বাস একটু জোরে ত্যাগ করে খাবারের রুচি কমে যায় আক্রান্ত গরু দুর্বল হয়ে যায় চোখ এবং দাঁতের মাড়ি ফ্যাকাশে হয়ে যায় প্রস্রাবের সাথে রক্ত বের হয় অনেক সময় পায়খানার সাথেও রক্ত বের হতে পারে গর্ভবতী গাভীর ক্ষেত্রে গর্ভপাত হতে পারে গরু কোনো কিছুর সাথে মাথা ঘষা, বৃত্তাকারে চার দিকে ঘোরাসহ এই ধরনের নানান অসংলগ্ন আচরণ করতে পারে পক্ষাঘাত, অচেতন হয়ে যাওয়া এবং শেষ পর্যন্ত মৃত্যুও হতে পারে

পোস্টমর্টেম লক্ষণসমূহ : মৃত গরুর দেহ পোস্টমর্টেম করলে হৃৎপিণ্ড অন্ত্রে সাব সেরোসাল হেমোরহেজ দেখা যায় প্লীহা কিছুটা বড় হয়ে যায় দেখতে লালচে নরম হয় যকৃৎ আকারে স্বাভাবিকের চেয়ে বড় হতে পারে

রোগ সনাক্তকরা : রোগের লক্ষণ দেখে রোগ নিরুপণ করা যায় নিশ্চিত হওয়ার জন্য আক্রান্ত গরুর রক্ত পরীক্ষা করা হয়

চিকিৎসা : রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা দিলে দ্রুত সেরে যায় এই রোগের চিকিৎসায় বিভিন্ন ধরনের ওষুধ রয়েছে বাজারে এখন যেসব ওষুধ পাওয়া যায় সেগুলোর মধ্যে ইমিডোকার্ব ডিমিনাজেন এসিচুরেট বেশি ব্যবহার করা হয় ট্রিপেন ব্লুও প্রয়োগ করা হয় মনে রাখা প্রয়োজন, কিছু ওষুধ রয়েছে বিষাক্ত তাই সব সময় ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবহার করা উচিত

প্রতিকারমূলক ব্যবস্খা : প্রতিরোধমূলক ব্যবস্খার মধ্যে উকুন নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি জন্য যেসব এলাকায় এই উকুনের প্রাদুর্ভাব বেশি সেখানে পানির মধ্যে একারাসিড জাতীয় ওষুধ গুলে গরুকে গোসল করাতে হবে তাতে গরুর শরীর উকুনমুক্ত হবে চার থেকে ছয় সপ্তাহ পর পর গোসল করালে উকুনের আক্রমণের সম্ভাবনা কমে দেশীয় গরুগুলোর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি বলে এই রোগে কম আক্রান্ত হয় কিন্তু সঙ্কর জাতের কিংবা বিদেশী জাতের গরু সহজেই এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে জন্য ভ্যাকসিন দেয়া প্রয়োজন অবশ্য কোনো গরু একবার এই রোগে আক্রান্ত হলে পরে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমে কারণ আক্রান্ত হওয়ার ফলে দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা জন্ম নেয় গরুকে রোগবালাই থেকে রক্ষার জন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্খা সবচেয়ে বেশি কার্যকর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য সুষ্ঠু যত্নশীল পরিচর্যা গরুকে রোগ থেকে রক্ষা করতে পারে কোনো কারণে রোগগ্রস্ত হলে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসার ব্যবস্খা করা রোগে মৃত্যুর ঝুঁকি হ্রাস করবে



পোলট্রি: হিটস্ট্রোক এড়ানোর উপায়

প্রচণ্ড গরম পড়েছে সারা দেশে প্রায় সব খামারেই হিটস্ট্রোকে মারা যাচ্ছে মোরগ-মুরগি গরমের সময় মোরগ-মুরগি চারপাশের তাপের কারণে তার দেহ থেকে তাপ বের করতে পারে না বলে শ্বাসকষ্ট হয় এবং হৃদস্পন্দন বেড়ে যায় একসময় এই মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায় বলে মোরগ-মুরগি হিটস্ট্রোকে মারা যায়

লক্ষ রাখতে হবে ফিড : সময় মুরগির ফিড গ্রহণের পরিমাণ কমে যায় সেই কারণে দিনের নির্দিষ্ট বেশি গরমের সময় ব্রিডার লেয়ারের ক্ষেত্রে ফিড না দেওয়াই ভালো শুধু পানি খাবে দিনের ঠাণ্ডা সময় যেমন ভোর সন্ধ্যার পর ফিড দিতে হবে

  সময় খামারে দেওয়া ফিডে বিশেষ লক্ষ রাখতে হবে, ফিডে যেন পুষ্টিমান সঠিক এবং বেশি থাকে যেমন স্বাভাবিক ১০০ গ্রাম ফিডের পুষ্টি ৯০ গ্রাম ফিডে থাকতে হবে সে কারণে ফিডে ব্যবহার করা প্রোটিনের ক্ষেত্রে অতি উচ্চমানের প্রোটিন ব্যবহার করতে হবে লক্ষ রাখতে হবে, এই প্রোটিনে প্রয়োজনীয় অ্যামাইনো এসিড মিথুনিন, লাইসিন ঘাটতি আছে কি না? যদি ঘাটতি থাকে তাহলে বাড়তি অ্যামাইনো এসিড মেশাতে হবে
 খামারে রেডি ফিড (পিলেট ফিড) ব্যবহারের ক্ষেত্রে ফিডে অ্যামাইনো এসিড মেশানোর উপায় থাকে না সে ক্ষেত্রে পানির মাধ্যমে তরল মিথুনিন যেমন রেডিমেড এটি-৮৮ পানিতে খাওয়াতে হবে প্রতি লিটার পানিতে এক থেকে দুই মিলিলিটার দিতে হবে ছাড়া অন্যান্য অ্যামাইনো এসিডের ঘাটতি পূরণের জন্য অ্যামাইনো লাইটস এবং অ্যামাইনো এসিড শক্তি সরবরাহের জন্য অ্যামাইনো-১৮ পানির সঙ্গে খাওয়াতে হবে

হিটস্ট্রোক প্রতিরোধ : গরমের সময় রক্ত চলাচল দ্রুততর হওয়ার জন্য হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায় কোনো কোনো সময় রক্ত জমাট হতে পারে এই রক্ত জমাট হওয়াটাই হিটস্ট্রোক এতে মুরগি মারা যেতে পারে সময় এসপিরিন ভিটামিন-সিযুক্ত কোনো মিশ্রণ যেমন এন্টি স্ট্রেস প্রিমিক্স দিনের উষ্ণতম সময় যেমন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত পানির মাধ্যমে খাওয়ালে হিটস্ট্রোকের পরিমাণ অনেক কমে যায় ছাড়া ফিডেও ভিটামিন-সিযুক্ত প্রিমিক্স ব্যবহার করা যেতে পারে

গরমের বাড়তি যত্ন : গরমে পোলট্রি খামারে বিশেষ যত্ন না নিলে ফ্লকে বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যেতে পারে এখনকার তাপজনিত ধকলে মুরগির দৈহিক ওজন কমে যাওয়াসহ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় ডিম উৎপাদন কমে যায় এবং মোরগ-মুরগির মৃত্যুও হতে পারে সময় বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে
 খামারে এক দিনের বাচ্চা আসার আগে পরিষ্কার ঠাণ্ডা পানির ব্যবস্থা করতে হবে প্রয়োজনে পানির সঙ্গে ভিটামিন সি, আখের গুড় অথবা ইলেকট্রোলাইটযুক্ত স্যালাইন পানির সঙ্গে দিতে হবে

 খামার শেডে বাতাসের অবাধ চলাচলের ব্যবস্থা করে দিতে হবে মুক্ত বাতাস শেড অভ্যন্তরের তাপমাত্রা শীতল রাখবে, সেই সঙ্গে অ্যামোনিয়াসহ অন্যান্য ক্ষতিকর গ্যাসের বিষক্রিয়াও মুক্ত রাখবে শেডে সিলিং ফ্যানের পাশাপাশি এগজস্ট ফ্যানের ব্যবস্থা করতে হবে
 শেডে মোরগ-মুরগি যেন আরামদায়ক পরিবেশে বাস করতে পারে সেদিকে নজর দিতে হবে অহেতুক এদের বিরক্ত করা যাবে না প্রতিটি বড় মুরগিকে এক বর্গফুটের অধিক জায়গা দিতে হবে
 অধিক রোদে টিনের চালা অতিরিক্ত গরম হলে দিনে দুই-একবার চালায় পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করতে হবে টিনের চালার নিচে চাটাই, হার্ডবোর্ড দিয়ে শিলিংয়ের (চাতাল) ব্যবস্থা করতে হবে

 শেডের চারপাশে সপ্তাহে দুবার চুন ছিটানোর ব্যবস্থা করতে হবে ব্রয়লার লিটার ভোর কিংবা রাতে ওলটপালট করে দিতে হবে
 খাবার পাত্র পানির পাত্রসংখ্যা বাড়িয়ে দিতে হবে পানির পাত্রে দিনে কমপক্ষে তিনবার পরিষ্কার ঠাণ্ডা পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন গরমের ধকলের কারণে মাইকোপ্লাজমা কলিব্যাসিলোসিস রোগের আক্রমণ বেড়ে যায় সে কারণে সময় মুরগির স্বাস্থ্যবিধি পুরোপুরি মেনে চলা প্রয়োজন বিশেষ করে ফিড পানিতে ভিটামিন-সি ভিটামিন- ব্যবহার করতে হবে

 গরমকালে বাতাসের আর্দ্রতা বেড়ে যাওয়ায় শেডের মেঝেয় অনেক সময় লিটার দ্রুত ভিজে যায় যার ফলে রোগ আক্রমণও বেশি হয় সে কারণে লিটারে পাউডার চুন ব্যবহার করতে হবে সময় ফিডের বস্তা খোলা রাখা যাবে না কারণ বাতাসের আর্দ্রতা বেড়ে ফিডে ছত্রাক বা মোল্ড জন্মায়, যা পোলট্রি খাদ্যের উপযুক্ত নয়




গবাদি পশুর গলাফুলা রোগ প্রতিকার

গলাফুলা একটি তীব্র প্রকৃতির রোগ যা গরু এবং মহিষকে আক্রান্ত করে এটি একটি ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ যা Pasteurella multocida দ্বারা সংঘটিত হয় রোগে মৃত্যুর হার খুবই বেশি বর্ষাকালে গলাফুলা রোগ বেশি দেখা যায় আমাদের দেশে বর্ষার শুরুতে এবং বর্ষার শেষে রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায় পশুর শরীরে স্বাভাবিক অবস্থায় রোগের জীবাণু বিদ্যমান থাকে কোনো কারণে যদি পশু ধকল যেমন ঠান্ডা, অধিক গরম, ভ্রমণজনিত দুর্বলতা ইত্যাদির সম্মুখীন হয় তখনই রোগ বেশি দেখা দেয় গলাফুলা রোগের প্রচলিত নাম ব্যাংগা, ঘটু, গলগটু, গলবেরা ইত্যাদি

 চিত্র- গলাফুলা রোগে আক্রান্ত পশুর মুখমন্ডলসহ গলা ফুলে উঠেছে

এপিডেমিওলজি রোগজননতত্ত্ব
 গলাফুলা (hemorrhagic septicemia) এশিয়া, আফ্রিকা, দক্ষিণ ইউরোপের কিছু দেশ মধ্যপ্রাচ্যে বিদ্যমান তবে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় এটি বেশি পরিলক্ষিত হয় গলাফুলা মূলত গরু মহিষের রোগ হলেও শুকর, ছাগল, ভেড়া, ঘোড়া, বাইসন, উট, হাতী এমনকি বানরেও রোগ হতে পারে রোগ বছরের যে কোনো সময় হতে পারে তবে বর্ষাকালে এর প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি বাহক পশুর টনসিল ন্যাজো-ফ্যারিনজিয়াল মিউকোসায় রোগের জীবাণু থাকে অনুকূল পরিবেশে রক্তে রোগের জীবাণুর সংখ্যা বেড়ে গিয়ে septicemia করে এই বৃদ্বিপ্রাপ্ত জীবাণু মরে গিয়ে এন্ডোটক্সিন নিঃসৃত হয় যার ফলে রক্ত দূষিত হয়ে পড়ে এন্ডোটক্সিন রক্তের ক্যাপিলারিস নষ্ট করে; ফলে এডিমা হয় এছাড়া এন্ডোটক্সিন একদিকে কোষ কলা বিনষ্ট করে দেহে হিস্টামিনের পরিমাণ বৃদ্ধি করে অন্যদিকে টিস্যু বিনষ্টের ফলে টিস্যুর প্রোটিন ভেঙ্গে রক্তে প্রোটিনের পরিমাণ হ্রাস পায় ফলে, এডিমার সৃষ্টি হয় সে কারণে রোগে আক্রান্ত পশুর গলা ফুলে যায় রক্তে জীবাণুর উপস্থিতির (septicemia) কারণে পশুর দ্রুত মৃতু্য হয়

লক্ষণ
  রোগ অতি তীব্র তীব্র দুই ভাবে হতে পারে অতি তীব্র প্রকৃতির রোগে হঠাৎ জ্বর (১০৬-১০৭০ ফা) হয়ে মুখ নাক দিয়ে তরল পদার্থ বের হতে থাকে পশু অবসাদগ্রস্থ হয়ে পড়ে খাওয়া বন্ধ করে দেয় এবং ২৪ ঘন্টার মধ্যে মৃতু্য ঘটে তীব্র প্রকৃতির রোগে আক্রান্ত পশু ২৪ ঘন্টার অধিক বেঁচে থাকে সময় পশুর এডিমা দেখা দেয় যা প্রথমে গলার নিচে, পরে চোয়াল, তলপেট এবং নাক, মুখ, মাথা কানের অংশে বিসতৃত হয়
 গলায় স্ফীতি থাকলে গলার ভেতর ঘড় ঘড় শব্দ হয় যা অনেক সময় দূর থেকে শোনা যায় প্রদাহযুক্ত ফোলা স্থানে ব্যথা থাকে এবং হাত দিলে গরম শক্ত অনুভূত হয় সূঁচ দিয়ে ছিদ্র করলে উক্ত স্থান হতে হলুদ বর্ণের তরল পদার্থ বের হয়ে আসে অনেক সময় কাশি হয় এবং চোখে পিচুটি দেখা যায় নাক দিয়ে ঘন সাদা শ্লেষ্মা পড়তে দেখা যায় সাধারণত লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার ৪৮ ঘন্টার মধ্যে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আক্রান্ত পশু মারা যায় মারা যাবার সাথে সাথে পেট খুব ফুলে উঠে এবং নাক মুখ দিয়ে তরল পদার্থ বের হতে থাকে পোস্টমর্টেম করলে পেরিকার্ডিয়াল স্যাক (pericardial sac) রক্ত মিশ্রিত তরল পদার্থ দেখা যায়, যা থোরাসিক (thoracic) এবং এবডোমিনাল ক্যাভিটি (abdominal cavity) তে বিসতৃত হতে পারে ফ্যারিনজিয়াল এবং সার্ভাইক্যাল লিম্ফনোডে বিন্দু আকৃতির (petechial) রক্তক্ষরণ পরিলক্ষিত হয়

অর্থনৈতিক গুরুত্ব
 গলাফুলা রোগের যথেষ্ট অর্থনৈতিক গুরুত্ব আছে বিশেষত, এশিয়া এবং আফ্রিকার কিছু দেশে এশিয়াতে ৩০% গবাদিপশু রোগের প্রতি সংবেদনশীল ভারত দুগ্ধ উৎপাদনে এশিয়াতে সর্বোচ্চ যেখানে ৫০% দুধ আসে মহিষ থেকে, যারা রোগের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল ভারতে গত চার দশক ধরে গলাফুলা রোগে মৃত্যু হার গবাদিপশুর মৃত্যুহারের ৪৬-৫৫% ১৯৭৪ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত ভারতে গবাদিপশুর ৫টি মহামারীতে আক্রান্ত গবাদিপশুর ৫৮.% মারা যায় এই ৫টি মহামারী হল ক্ষুরারোগ, রিন্ডারপেষ্ট, বাদলা, এনথ্রাক্স এবং গলাফুলা শ্রীলংকায় ১৯৭০ এর দশকে পরিচালিত একটি অপঃরাব সারভ্যাইল্যান্স স্টাডিতে দেখা গেছে গলাফুলা আক্রান্ত স্থানসমূহে বছরে প্রায় ১৫% মহিষ এবং % গরু গলাফুলার কারণে মারা যায় পাকিস্তানে একটি রির্পোটে দেখা গেছে সেখানে গবাদিপশুর মোট মৃত্যুর ৩৪.% মারা যায় গলাফুলা রোগে মায়ানমারে পশু রোগ নিয়ন্ত্রণে বরাদ্দকৃত মোট বাজেটের ৫০ ভাগ ব্যয় হয় গলাফুলা রোগ দমনে গলাফুলা রোগে শুধু গবাদিপশুর মৃত্যুই ঘটে না, সাথে সাথে বেশ কিছু অপ্রত্যক্ষ ক্ষতিও হয় যেমন -
 উৎপাদন হ্রাসঃ মাংস, দুধ, জোয়াল টানা, হালচাষের বিকল্প উপায়ের জন্য মোট ব্যয় ইত্যাদি পশুর প্রজনন ক্ষমতা বিঘি্নত হওয়া, চিকিংসা খরচ ইত্যাদি

প্রতিরোধ
  রোগ উচ্ছেদ করা অসম্ভব কারণ রোগের জীবাণু স্বাভাবিক অবস্থায় পশুর দেহে থাকে তবে নিম্নোক্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করে রোগ প্রতিরোধ করা যায়
 রোগাক্রান্ত পশুকে সুস্থ পশু থেকে আলাদা করে সুস্থ পশুকে টিকা দানের ব্যবস্থা করতে হবে
 মড়কের সময় পশুর চলাচল নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে
 হঠাৎ আবহাওয়া পরিবর্তনের ক্ষেত্রে পশুর পরিচর্যার ব্যবস্থা করতে হবে
 টিকা প্রয়োগের মাধ্যমে রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে ঢাকার মহাখালীতে অবস্থিত এল.আর. আই কতৃর্ক প্রস্তুতকৃত টিকার নাম গলাফুলা টিকা লোকাল স্ট্রেইন দ্বারা প্রস্তুতকৃত এই অয়েল এডজুভেন্ট টিকা সাধারণত প্রাপ্তবয়স্ক ( মাস বয়সের উপরে) গবাদিপশুকে মিলি মাত্রায় ছাগল ভেড়াকে মিলি মাত্রায় প্রয়োগ করতে হয় রোগের প্রাদুর্ভাব আছে এরূপ এলাকায় মাস বা তদুধর্ব বয়সী বাছুরে প্রাপ্ত বয়স্ক গরুর অর্ধেক মাত্রায় টিকা দিতে হয় এলাম অধঃপাতিত (Alum precipitated) টিকা মাংসে প্রদান করা হয় যেহেতু দুই ধরনের টিকাই মাঠপর্যায়ে ব্যবহার হয় তাই বিষয়টির দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে কারণ অয়েল এডজুভেন্ট টিকা তেল থেকে প্রস্তুতকৃত বিধায় এই টিকা ভুলক্রমে মাংসে প্রদান করলে মাংসে প্রদাহ সৃষ্টি হয়ে মাংসের ক্ষতি হয় এবং সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে টিকা প্রদানের - সপ্তাহ পর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা জন্মাতে শুরু করে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৎসর কাল পর্যন্ত বজায় থাকে এই টিকা মৃত জীবাণুর দ্বারা প্রস্তুত বিধায় এই টিকা প্রদানের মাধ্যমে রোগ বিস্তারের কোনো সম্ভাবনা নাই টিকা প্রয়োগের স্থান / দিন পর্যন্ত ফোলা থাকতে পারে ত্রুটিপূর্ণ ইনজেকশনের কারণে এই ফোলা স্বাভাবিক এর চেয়ে কয়েকদিন বেশি থাকতে পারে ক্ষেত্র বিশেষে এনাফাইলেকটিক শক দেখা দিতে পারে কোনো এলাকায় বা খামারে টিকা প্রদানের পূর্বে অল্প কয়েকটি গবাদিপশুকে টিকা প্রদানের পর ২৫-৩০ মিনিট অপেক্ষা করে কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যায় কিনা তা পর্যবেক্ষণ করা শ্রেয় যদি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায় তবে উক্ত বোতলের টিকা পুনরায় ব্যবহার করা যাবে না অয়েল এডজুভেন্ট টিকা বেশ ঘন হওয়ায় এই টিকা প্রদানে মোটা বারের নিডল ব্যবহার করা সুবিধাজনক

রোগ নির্ণয়
 হঠাৎ মৃত্যু হয় ধরনের রোগ যেমন বজ্রপাত, সাপে কাটা, বাদলা রোগ, রিন্ডারপেস্ট, এনথ্রাক্স ইত্যাদি থেকে গলাফোলা রোগকে আলাদা করতে হবে সেরোলজিক্যাল টেস্ট যেমন Indirect hemagglutination test উচ্চ টাইটার লেভেল (:১৬০ বা তার বেশি) পাওয়া গেলে রোগ সমন্ধে নিশ্চিত হওয়া যায়

চিকিৎসা
 আক্রান্ত পশুর চিকিৎসায় বিলম্ব হলে সুফল পাওয়া যাবে না তাই রোগের উপসর্গ দেখা দেয়ার সাথে সাথে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে রোগের চিকিৎসায় সালফোনামাইড গ্রুপ যেমন সালফাডিমিডিন (৫০ কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ১৫-৩০ মিলি হিসেবে প্রত্যহ একবার করে তিনদিন শিরা বা ত্বকের নিচে), ট্রাইমিথোপ্রিম-সালফামেথাক্সাসোল কম্বিনেশন (৪৫ কেজি দৈহিক ওজনের জন্য - মিলি), অক্সিটেট্রাসাইক্লিন, পেনিসিলিন ক্লোরামফেনিকল জাতীয় ঔষধ অধিক কার্যকর

Ampicillin, Tetracycline, Erythromycin, Sulphonamide জাতীয় ইনজেকশন গভীর মাংসে দিয়ে ভাল ফল পাওয়া যায় Sulphadimidin ঔষধ শীরায় প্রয়োগ করে দ্রুত ফল পাওয়া যায় আমাদের দেশে চিকিত্সাটা বেশি ব্যবহূত হয় Oxytetracycline/Streptophen ইনজেকশন গভীর মাংসে প্রয়োগ করে কার্যকরী ফল পাওয়া যায় টিকার ব্যবহার মাত্রা প্রয়োগ পদ্ধতি: বাংলাদেশের মহাখালীর খজও - টিকা পাওয়া যায়- . অয়েল এ্যাডজুভেন্ট টিকা: গরু/মহিষ- মি.লি চামড়ার নিচে দিতে হয় ছাগল/ভেড়া- মি.লি চামড়ার নিচে দিতে হয় (অয়েল এ্যাডজুভেন্ট টিকা ঘন হওয়ায় মোটা বোরের নিডল ব্যবহার করতে হবে)

প্রতিরোধ
 ভ্যাকসিনই রোগ প্রতিরোধের সবচেয়ে ভাল উপায় মূলত তিন ধরনের ভ্যাকসিন ব্যবহার করা হয়ে থাকে এগুলো হল প্লেইন ব্যাকটেরিন, এলাম অধ:পাতিত ব্যাকটেরিন এবং অয়েল এডজুভেন্ট ব্যাকটেরিন এর মধ্যে মাস বিরতিতে এলাম অধ:পাতিত ব্যাকটেরিন এবং থেকে ১২ মাস অন্তর অয়েল এডজুভেন্ট ভ্যাকসিন দিতে হয় ভালো ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত খামারে বাছুরকে থেকে মাস বয়সে প্রথম, মাস পরে বুস্টার এবং এরপর বছরে একবার টিকা দিতে হয় উন্মুক্ত খামারে বর্ষা শুরু হওয়ার আগেই বাৎসরিক টিকার কোর্স শুরু করতে হয়

 লেখক: ডাঃ , এইচ. এম. সাইদুল হক
 এক্সিকিউটিভ, ভেটেরিনারী সার্ভিসেস, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যাল
 তথ্যসূত্র: পোলট্রি, পশুসম্পদ মৎস্য বিষয়ক মাসিক পত্রিকাখামার






গবাদিপশুর থাইলেরিয়াসিস রোগ প্রতিকার

থাইলেরিয়াসিস গবাদিপশুর রক্তবাহিত এক প্রকার প্রোটোজোয়াজনিত রোগ এই জীবাণু গরু, মহিষ, ছাগল ভেড়াকে আক্রান্ত করে সাধারণত গ্রীষ্মকালে থাইলেরিয়াসিস রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায় থাইলেরিয়ার জীবাণু আক্রান্ত গরু থেকে সুস্থ গরুতে আঠালির মাধ্যমে রোগ সংক্রমিত হয়ে থাকে গ্রীষ্মকাল আঠালির প্রজনন বংশবৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত সময় কারণে গ্রীষ্মকালে গরু আঠালি দ্বারা বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে এবং দ্রুত রোগ ছড়াতে সাহায্য করে

 বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে থাইলেরিয়াসিস দেখা যায় Theileria গণভুক্ত বিভিন্ন প্রজাতির প্রোটোজোয়া দ্বারা রোগ সৃষ্টি হয়ে থাকে বাংলাদেশে গরুতে Theileria annulata আক্রান্তের হার খুব কম হলেও মৃত্যু হার প্রায় ৯০-১০০% রোগের ক্লিনিক্যাল লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার পর পশুর রক্তের হিমোগ্লোবিনের মাত্রা খুব নীচে নেমে যায় ফলে রোগটি নির্ণিত হওয়ার পর চিকিৎসা দিলেও গরুকে সুস্থ করে তোলা প্রায়ই সম্ভব হয় না তাছাড়া মাঠপর্যায়ে গরুর রক্ত পরিবহন বাস্তবে সম্ভব হয়ে উঠে না রোগের চিকিৎসার জন্য উন্নতমানের ঔষধের দাম খুব বেশি এবং তা সর্বত্র সহজে সব সময় পাওয়া যায় না কারণে থাইলেরিয়াসিস অর্থনৈতিক ভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ রোগ সঙ্কর জাতের গরুতে বেশি দেখা যায় সঙ্কর জাতের একটি গাভীর দাম ৫০ হাজার থেকে লক্ষ টাকা গবাদিপশুর খামারের ক্ষতিকর রোগগুলির মধ্যে থাইলেরিয়াসিস একটি অন্যতম রোগ আমাদের দেশের প্রায় প্রতিটি জেলাতেই রোগ দেখা যায় বিভিন্ন কারণে থাইলেরিয়া রোগ নির্ণয় করতে অনেক সময় লেগে যায় খামারীদের কাছাকাছি এলাকায় প্রায়শ রোগ নির্ণয় কেন্দ্র থাকে না থাইলেরিয়া রোগে প্রতিবছর বাংলাদেশে কোটি কোটি টাকা মূল্যের গো-সম্পদ নষ্ট হয়ে থাকে

রোগের জীবন চক্র
 থাইলেরিয়া রোগের মাধ্যমিক পোষক হিসাবে কাজ করে প্রায় ছয় প্রজাতির আঠালি যথা-
 Rhipicephalus Spp
 Hyalomma Spp
 Boophilus Spp
 Haemophysalis Spp
 Ornithodoros Spp
 Dermacentor Spp

 বাংলাদেশে প্রধানত Hyalomma Spp -এর আঠালি Theileria annulata প্রোটোজায়ার মাধ্যমিক পোষক হিসাবে কাজ করে থাইলেরিয়া আক্রান্ত আঠালির লালা গ্রন্থির মধ্যে অবস্থিত Sporozoits রক্ত শোষণকালে সুস্থ গরুর দেহে প্রবেশ করে পরে লসিকা গ্রন্থি প্লীহার লসিকা কোষকে আক্রান্ত করে ম্যাক্রোসাইজোন্ট বা ককস্-ব্লু বডি (Koch’s blue bodies) সৃষ্টি করে যা মাইক্রোসাইজোন্ট- পরিণত হয় এই মাইক্রোসাইজোন্ট লোহিত কণিকাকে আক্রান্ত করে পাইরোপ্লাজম সৃষ্টি করে রক্ত শোষণের সময় এই পাইরোপ্লাজম আঠালির দেহে প্রবেশ করে আঠালির দেহের মধ্যে বিভিন্ন পদ্ধতিতে রূপান্তরিত হয়ে আঠালির লালা গ্রন্থিতে অবস্থান নেয় যা পরে গবাদিপশুর রক্ত শোষণকালে প্রাণীর দেহে প্রবেশ করে আক্রান্ত আঠালি সুস্থ গরুকে কামড়ানোর -১০ দিন পর পশুর দেহে তাপ দেখা দেয়

রোগ লক্ষণ
 গরুর প্রবল জ্বর (১০৪-১০৭০ ফা), ক্ষুধামান্দ্য, রক্তশূন্যতা, চোখ দিয়ে পানি ঝরা, রুমেনের গতি হ্রাস, লসিকা গ্রন্থি ফুলে যাওয়া, রক্ত আম মিশ্রিত ডায়ারিয়া নাসিকা থেকে শ্লেম্মা নির্গত হয় সময় গরু শুকিয়ে যায় এবং কোনো এন্টিবায়োটিক দ্বারা চিকিৎসায় ফল পাওয়া যায় না দুধ উৎপাদন একদম কমে যায়, গরু শুয়ে থাকতে বেশি পছন্দ করে, হাঁপায় এবং ধীরে ধীরে গরুর মৃত্যু ঘটে মৃত্যুর পূর্বে হঠাৎ করে গরুর শরীরের তাপমাত্রা হ্রাস পায় সাধারণত আক্রান্ত হবার ১৮-২৪ দিন পর প্রাণী মারা যায় থাইলেরিয়ায় আক্রান্ত প্রাণী চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে উঠলে কিছুটা প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করে তবে প্রাণীটি রোগের বাহক হিসাবে কাজ করে

রোগ নির্ণয়
 রোগের লক্ষণ, ইতিহাস এবং চিকিৎসকের অভিজ্ঞতা দিয়ে প্রাথমিক ভাবে এই রোগ নির্ণয় করা যায় ল্যাবরেটরিতে আক্রান্ত প্রাণীর রক্ত জেম্সা স্টেইন করে অণুবীক্ষণ যন্ত্রে পাইরোপ্লাজম দেখে সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় করা যায়

চিকিৎসা
 রোগ নির্ণয়ে বেশি দেরী হলে চিকিৎসায় তেমন উপকার হয় না দ্রুত রোগ নির্ণয় করে মাত্রামত Buparvaquone, Diminazene diaceturate ইত্যাদি প্রয়োগ করতে হবে সহায়ক চিকিৎসা হিসাবে ভিটামিন ই১২ ইনজেকশন, Hartmann’s Solution ইত্যাদি প্রয়োগ করতে হবে সম্ভব হলে রক্ত সংযোজন করতে হবে যা দূরূহ ব্যাপার আক্রান্ত প্রাণীর শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্যারাসিটামল জাতীয় ঔষধ খাওয়াতে হবে পশুকে ছায়াযুক্ত আরামদায়ক পরিবেশে রাখতে হবে প্রচুর ঠান্ডা পানি পান করতে দিতে হবে

প্রতিরোধ
 ডেইরী খামারীদেরকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে থাইলেরিয়া রোগ সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে যে কোন মূল্যে পশুর খামারকে উকুন, আঠালি ইত্যাদি থেকে মুক্ত রাখতে হবে গোয়াল ঘর এর চতুর্দিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে প্রতি মাস অন্তর গাভীকে আঠালি প্রতিরোধক ইনজেকশন প্রয়োগ করে আঠালি মুক্ত রাখতে হবে গ্রীষ্মকালে সপ্তাহে দুই বার গোয়াল ঘরে আঠালিনাশক ঔষধ মাত্রামত সপ্রে করলে গোয়াল ঘর আঠালি মুক্ত থাকে আক্রান্ত এলাকার সন্দেহজনক সকল গবাদিপশুকে Buparvaquone, Diminazene diaceturate ইত্যাদি প্রতিশেধক হিসাবে মাত্রামত প্রয়োগ করা উচিত

 লেখক: ডাঃ মনোজিৎ কুমার সরকার
 ভেটেরিনারি সার্জন,উপজেলা পশুসম্পদ অফিস, রংপুর
 তথ্যসূত্র: পোলট্রি, পশুসম্পদ মৎস্য বিষয়ক মাসিক পত্রিকাখামার




গবাদিপশুর মিল্ক ফিভার রোগ

অধিক দুধ উৎপাদন এবং একই সাথে একের অধিক বাচ্চা প্রসবকারী গাভীর গর্ভাবস্থার শেষ তিন মাস, প্রসবকালীন সময় এবং প্রসব পরর্বতী - দিনের মধ্যে ক্যালসিয়ামের অভাবে শারীরিক স্বাভাবিক তাপবৃদ্ধি ব্যাতিরেকে পেশির অবসাদগ্রস্থতার লক্ষণ প্রকাশ হওয়াকে দুগ্ধ জ্বর বলে

রোগের কারণ
 প্রধানত রক্তে আয়নাইজড ক্যালসিয়ামের পরিমাণ কমে যাওয়ার ফলে দুগ্ধ জ্বর হয় দুধ দেয় (milking cow) এবং দুধ দেয় না কিন্তু গর্ভবতী এরূপ গাভীর (dry pregnant cow) ক্যালসিয়ামের পরিমাণে তারতম্য হয়ে থাকে শুষ্ক পিরিয়ডে (dry period) প্রতিদিন ক্যালসিয়ামের চাহিদা থাকে ৪২ গ্রাম পক্ষান্তরে দুগ্ধবতী গাভীতে প্রতিদিন এর পরিমাণ থাকা চায় ৮২ গ্রাম শুধু তাই নয় dry pregnant cow G ক্যালসিয়াম শোষণের হার ৩৩% হলেও দুগ্ধ জ্বর প্রতিরোধের জন্য হদুগ্ধবতী গাভীতে এটি ৫২% থাকতে হবে
 প্রধানত তিন কারণে গাভীর হেদহে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ হ্রাস পেয়ে দুগ্ধজ্বর হতে পারে
 ) গাভীর পাকান্ত্র থেকে শোষিত অস্থি থেকে রক্তে আগত ক্যালসিয়ামের পরিমাণ ভ্রূণ শালদুধের (colostrum) চাহিদার চেয়ে অধিক হলে রোগ দেখা দেয়
 ) গর্ভাবস্থা কলস্ট্রাম পিরিয়ডে পাকান্ত্রে সুষ্ঠুভাবে ক্যালসিয়াম শোষিত না হলে রোগ দেখা দেয় গাভীর গর্ভকালীন সময়ে গর্ভস্থ বাচ্চার শারীরিক গঠন বৃদ্ধির প্রয়োজনে বিশেষ করে হাড়ের গঠন প্রক্রিয়ায় ক্যালসিয়ামের গুরত্ব অধিক জন্য প্রতিদিন প্রায় গ্রাম করে ক্যালসিয়াম দরকার হয় এবং গর্ভস্থ বাচ্চা তার মার কাছ থেকে পরিমাণ ক্যালসিয়াম গ্রহণ করে
 নিম্নোক্ত কারণে পাকান্ত্রে ক্যালসিয়াম শোষণে ব্যাঘাত ঘটে থাকে-
 ) খাদ্যে ক্যালসিয়ামের অভাব
 ) ক্ষুদ্রান্তে অদ্রবণীয় ক্যালসিয়াম অক্সালেট লবণ সৃষ্টি
 ) অন্ত্রপ্রহদাহ (Enteritis)
 ) ক্যালসিয়াম ফসফরাসের অনুপাতের তারতম্য (স্বাভাবিক হার .:)
 ) ভিটামিন ডি এর অভাব ইত্যাদি
 ) অস্থির সঞ্চিত ক্যালসিয়াম দ্রুত পযার্প্ত হারে নিষ্ক্রান্ত না হওয়ার কারণে রক্তে ক্যালসিয়ামের স্বাভাবিক মাত্রা বজায় থাকে না ফলে রোগ দেখা দেয়

 শরীরে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি হলে প্যারাথাইরয়েড গ্রন্থি হতে নিঃসৃত প্যারাথরমোন শরীরের হাড় হতে ক্যালসিয়াম ফসফরাস নিঃসরণের জন্য উদ্দীপনা জোগায় হরমোন ক্যালসিয়াম শোষণে ভূমিকা পালন করে গর্ভকালের শেষ সময়ে খাদ্যে ম্যাগনেসিয়াসের ঘাটতি হলে রোগ দেখা দেয় এবং সময়ে গর্ভবতী গাভীর শরীরে ইস্ট্রোজেন হরমোনের পরিমাণ বাড়তে থাকে বিধায় হরমোন ক্যালসিয়াম নিঃসরণে বাধা দেয় অবস্থা ছাড়াও অধিকহারে দানাদার খাদ্য গ্রহণ (grain engorgement), রুমেন নড়াচড়ায় আড়ষ্ঠতা (rumen stasis) বিশেষ করে ট্রমাটিক রেটিকুলোপেরিটোনাইটিস, উদরাময় জনিত না খাওয়া (starvation), জোর করে শারীরিক ব্যায়াম করানো (forced exercise) এবং অন্যান্য পরিবেশজনিত কারণ বিশেষ করে অতিরিক্ত ঠান্ডা বাতাসের আর্দ্রতার কারণে গাভীর শরীরে ক্যালসিয়ামের অভাব দেখা দিতে পারে

রোগ লক্ষণ
 গরুর রক্তের সিরামে স্বাভাবিক ক্যালসিয়াম এর মাত্রা হল -১২ মিগ্রা/মিলি এর মধ্যে অর্ধেক থাকে প্রোটিনের সাহেথ বন্ধনযুক্ত অবস্থায় (Protein bound) যা অকার্যকর বাকী অর্ধেক থাকে আয়নিক অবস্থায়, যা ক্যালসিয়ামের সক্রিয় অংশ সিরামের ক্যালসিয়াম লেভেল প্রতি ১০০ মিলিতে মিগ্রা এর নীচে আসলে সাবক্লিনিক্যাল লক্ষণ প্রকাশ পায় গাভীর রক্তরসে ক্যালসিয়ামের পরিমাণের উপর র্নিভর করে রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়

এপিডেমিওলজি
 দুগ্ধ জ্বর হওয়ার পিছনে বেশ কিছু ফ্যাক্টর কাজ করে এগুলো হলঃ
বয়স
 গাভীর বয়স বৃদ্ধির সাথে রোগের প্রার্দুভাব বৃদ্ধি পায় অধিক বয়স্ক গাভীতে (- বাচ্চা প্রসবের পর) রোগ অধিক হয় কারণ বৃদ্ধ বয়সে একদিকে অস্থি থেকে ক্যালসিয়াম মবিলাইজেশন হ্রাস পায়, অন্যদিকে পাকান্ত্রে ক্যালসিয়াম শোষণ হ্রাস পায়
জাত
 জার্সি জাতের গাভী (৩৩%) রোগ অধিক আক্রান্ত হয় এছাড়া ব্রাউন সুইস s(Brown Swiss), আইশায়ার (Ayrshere), হলিস্টিন-ফ্রিজিয়ান (Holstein frizian) জাতের গাভীও রোগে আক্রান্ত হয়
হরমোন
 বাচ্চা প্রসবের কিছুদিন পুর্ব থেকেই এবং ইস্ট্রাস পিরিয়ডে ইস্ট্রোজেনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় পরিণামে আন্ত্রিক গতিশীলতা হ্রাস পায় বলে অন্ত্রে ক্যালসিয়ামের শোষণ কমে গিয়ে হাইপোক্যালসেমিয়া বা দুগ্ধ জ্বর দেখা যায় এছাড়া ইস্ট্রোজেন হরমোন অস্থি থেকে ক্যালসিয়াম মবিলাইজেশনেও বাধা দেয়

অর্থর্নৈতিক গুরুত্ব
 স্নায়বিক কার্যক্ষমতা বিঘ্নিত হওয়ার ফলে গাভীর স্বাভাবিক আচরণে অসামঞ্জস্যতা দেখা হেদয় এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে গাভী দাঁড়াতে পারে না আক্রান্ত গাভীতে প্রসব জটিলতা, গর্ভফুল আটকে পড়া (কারণ সময়ে জরায়ুর মাংসপেশী শিথিল থাকায় জরায়ুর সংকোচন ক্ষমতা কমে যায় এবং গর্ভফুল বিচ্ছিন্ন পৃথক হওয়ার প্রক্রিয়াটি দীর্ঘায়িত হয়) ইত্যাদি জটিল সমস্যা পরিলক্ষিত হয় ছাড়া জরায়ুর পেশীর শিথিলতা বা দুর্বল হওয়ার কারণে জরায়ু থলথলে (flabby) হয় এবং জরায়ুর র্নিগমনের (uterine prolapse) সম্ভবনা বেড়ে যায় যথাসময়ে সঠিক চিকিৎসার অভাবে গাভী মারা যায় মিল্ক ফিভার এর কারণে গাভীর উর্বরতা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পায় আক্রান্ত গাভীতে ওলান প্রদাহের সম্ভবনা বেড়ে যায় কারণ, সময়ে বাঁটের স্ফিংটার পেশী শিথিল থাকার ফলে বাঁটের ছিদ্র (teat canal) দিয়ে ব্যাকটেরিয়া প্রবেশের সম্ভাবনা বেড়ে যায় যথাসময়ে সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা না করলে গাভী মারা যায়
চিকিৎসা
 দুধ জ্বরের সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা হল ক্যালসিয়াম বোরোগ্লুকোনেট (৪৫০ থেকে ৫৪০ মিলির ২০% সলিউশন) মাত্রার সলিউশনে গ্রাম ক্যালসিয়াম থাকে যা সরাসরি শিরায় বা চামড়ার নিচে দিতে হয় বাজারে ধরনের বিভিন্ন ক্যালসিয়াম সলিউশন এর যে কোনটি প্রস্তুতকারক কোমপানীর নির্দেশমত প্রয়োগ করতে হবে চিকিৎসার ফলে প্রতিক্রিয়া দ্রুত হ্রাস পায় এবং ইনজেকশন দেয়ার সাথে সাথেই শতকরা ৬০ ভাগ এবং ঘন্টার মধ্যে ১৫ ভাগ গাভী আরোগ্য লাভ করে অপযার্প্ত মাত্রায় ক্যালসিয়াম সলিউশন দিয়ে চিকিৎসা করলে গাভী সম্পূর্ণ রোগমুক্ত হয় না এবং পশু উঠে দাঁড়াতে সক্ষম হয় না অপরদিকে ক্যালসিয়াম সলিউশন অতিরিক্ত মাত্রায় এবং দ্রুত শিরায় ইনজেকশন দিলে পশুর মৃতু্যর আশঙ্কা থাকে উল্লেখ্য, রোগে প্রতি লিটার দুধ হতে . গ্রাম ক্যালসিয়াম বের হয়ে যায় হিসাব করে দেখা গেছে ১৮ লিটার দুধ দিতে সক্ষম একটি গাভীর প্রতি দিন ২২ গ্রাম ক্যালসিয়াম ব্যয়িত হয় কাজেই উপরোক্ত পরিমাণ ক্যালসিয়াম শুধুমাত্র কয়েক ঘন্টার ঘাটতি পূরণে সক্ষম নয় কারণে পূর্বের অবস্থার প্রত্যার্বতন প্রতিরোধে (Follow-up therapy) সরাসরি মুখে ক্যালসিয়াম দেয়া যেতে পারে ধরনের ক্যালসিয়াম সলিউশন প্রদান করলে সিরামের স্বাভাবিক ক্যালসিয়াম লেভেল বজায় থাকে এবং পশুর Homeostatic পদ্ধতি কার্যকর হওয়া পর্যন্ত চালিয়ে যেতে হবে উন্নত দেশগুলোতে শিরায় ক্যালসিয়াম দেয়ার পর দীর্ঘ সময় ধরে সিরামে (serum) ক্যালসিয়াম মাত্রা বজায় রাখার জন্য মুখে আয়নিক ক্যালসিয়াম (Ionic oral calcium) জেল form দেয়া হয় আক্রান্ত গাভী যদি শক্ত বা পিচ্ছিল মেঝেতে শায়িত থাকে তবে খড় দিয়ে বিছানার ব্যবস্থা করে দিতে হবে

প্রতিরোধ
 প্রধানত দুটো নীতি অনুসরণ করে গাভীর দুগ্ধ জ্বর প্রতিরোধ নিয়ন্ত্রণ করা যায় যথাঃ
 ) খাদ্য সংশোধন (Correction of diet) এবং
 ) প্রি -ডিসপোজিং ফ্যাক্টর সংশোধন (Correction of pre-disposing factors)
খাদ্য সংশোধন
 গাভীর শুষ্ক অবস্থায় ক্যালসিয়াম সরবরাহ পরিহার করতে হবে কারণ উচ্চ মাত্রার ক্যালসিয়াম থাকলে হাড়ের ক্যালসিয়াম মবিলাইজেশন নিষ্ক্রিয় অবস্থায় থাকে ফলে বাচ্চা প্রসব কলস্ট্রামের জন্য প্রচুর ক্যালসিয়াম এর প্রয়োজনে অস্থি থেকে দ্রুত মবিলাইজেশন হতে পারে না পাকান্ত্রে হঠাৎ গোলযোগ হলে ক্যালসিয়াম শোষণ হয় না অপরদিকে অস্থি থেকে ক্যালসিয়াম মবিলাইজেশন হয় না এর ফলে রোগের সৃষ্টি হয় ধরনের গাভীদের কমপক্ষে - মাসের মত চা চামচ করে ডাই ক্যালসিয়াম ফসফেট (DCP) পাউডার দৈনিক একবার খাবারের সাথে মিশিয়ে খাওয়াতে হবে ভিটামিন ডি পাকান্ত্রের ক্যালসিয়াম শোষণ এবং অস্থি থেকে রক্তে ক্যালসিয়াম প্রবাহিত করতে সাহায্য করে তাই ভিটামিন ডি প্রয়োগের মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ করা যায়
প্রি-ডিসপোজিং ফ্যাক্টর সংশোধন
 বয়স, জাত হরমোন লেভেলকে বিবেচনায় রেখে যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে এছাড়া বাচ্চা প্রসবকালীন সময়ে যাতে ধকল না হয় তার ব্যবস্থা করতে হবে জন্য বাচ্চা প্রসবের ৪৮ ঘন্টা পূর্ব পরে গাভীকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে

 লেখক: ডাঃ . এইচ. এম. সাইদুল হক
 এক্সিকিউটিভ, ভেটেরিনারী সার্ভিসেস, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস
 তথ্যসূত্র: পোলট্রি, পশুসম্পদ মৎস্য বিষয়ক মাসিক পত্রিকাখামার





গবাদিপশুর ফুট রট রোগ নিয়ন্ত্রণ

ফুট রট গবাদিপশুর পায়ের ক্ষুরের চারপাশে ক্ষুরের মধ্যবর্তী স্থানের টিস্যুর প্রদাহজনিত একটি সংক্রামক রোগ সকল শ্রেণীর সব বয়সের পশুই (গাভী, বলদ, ষাঁড়, বকনা ইত্যাদি) রোগে আক্রান্ত হতে পারে রোগকে ইন্টারডিজিটাল নেক্রোব্যাসিলোসিস, ফাউল ইনদি ফুট, ফুট রট বা ইন্টার ডিজিটাল ফ্লেগমন হিসাবেও আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে

কারণতত্ব এপিডেমিওলজী
 ফুট রট সাধারণত Fusobacterium necrophorum দ্বারা সংঘটিত হয়ে থাকে তবে অন্যান্য ব্যাকটেরিয়া যেমন Bacterorides melaninogenicus রোগের কারণ হতে পারে পরীক্ষামূলকভাবে F. necrophorum গবাদিপশুর ইন্টারডিজিটাল চামড়ার মাঝে ইনজেকশন দিলে ইন্টারডিজিটাল নেক্রোব্যাসিলোসিস এর বৈশিষ্ট্যপূর্ণ লিশান পরিদৃষ্ট হয় এই ব্যাকটেরিয়ার অধিকাংশ আইসোলেট পরীক্ষা করে দেখো গেছে এরা এবং অই গ্রুপের অর্ন্তভুক্ত এরা একজাতীয় exotoxin উৎপন্ন করে যা ইনজেকশন করলে গবাদি পশু ইঁদুর আক্রান্ত হয় আবার লিশান থেকে প্রাপ্ত আর একজাতীয় isolotes যারা ইন্টারডিজিটাল নেক্রোব্যাসিলোসিস হিসাবে শ্রেণীভুক্ত নয় এবং সুস্থ গরুর পা থেকে সংগৃহীত হয় এরা বায়োটাইপ হিসাবে (F. necrophorum subspecies funduliforme) চিহ্নিত হয় এরা তেমন ক্ষতিকারক নয় Bacteroides nodosus এর স্ট্রেইন যা ভেড়ার ফুট রট করে তা গবাদিপশুর ক্ষুর থেকে সংগৃহীত হয়েছে তবে তা অল্প বিস্তর ইন্টারডিজিটাল ডার্মাটাইটিস করে থাকে কিন্তু এরা আবার মারাত্নক ইন্টারডিজিটাল নেক্রোব্যাসিলোসিস রোগের সৃষ্টি করতে পারে
 পৃথিবীর প্রায় সবদেশেই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়ে থাকে এবং এর ফলে -১০% গবাদিপশু খোঁড়া হয়ে যেতে পারে সকল বয়সের গরু এবং দুই মাস বয়সের বেশি ভেড়া ছাগলে রোগ দেখা দিতে পারে বর্ষা স্যাঁৎসেঁতে আবহাওয়ায় রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি হয়ে থাকে ডেয়রী খামারের গাভীতে রোগ হলে অত্যন্ত ক্ষতি হয় দেশী জাতের গরু অপেক্ষা বিদেশী জাতের সংকর জাতের গাভীতে রোগ মারাত্নক হয়ে থাকে আক্রান্ত গরুর পায়ের ক্ষত হতে নিঃসৃত রস থেকে রোগজীবাণু অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে যদিও রোগ বিচ্ছিন্নভাবে দেখা দেয় তথাপি তা অনুকূল পরিবেশে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে

রোগ বিস্তার
 সাধারণত আক্রান্ত গরু থেকে রোগের বিস্তার ঘটে আক্রান্ত প্রাণীর ক্ষুরের ক্ষত স্থান থেকে নিঃসৃত রস প্রচুর জীবাণু বহন করে যা থেকে সুস্থ প্রাণী আক্রান্ত হয়ে থাকে গবাদি পশুর পায়ের ক্ষুরের করোনেট বা দুই ক্ষুরের মধ্যবর্তী স্থানের টিসু্যতে কোনো কিছু দ্বারা আঘাতের ফলে ক্ষত হলে সর্বদা কাদা-পানি বা গোবরের মাঝে পা রাখলে ক্ষতস্থান দিয়ে রোগজীবাণু সহজেই দেহে প্রবেশ করে রোগের সৃষ্টি করতে পারে
 এছাড়াও শক্ত স্থান, ধারালো পাথরের নুড়ি অথবা চারণক্ষেত্রের শক্ত ধান বা গমের মুড়া থেকে ক্ষুরের নরম টিসু্য আঘাতপ্রাপ্ত হলে সেখান থেকেও সংক্রমণ ঘটতে পারে যে কোনো কারণেই হোক না কেন পা যদি সব সময় ভেজা থাকে তাহলে ক্ষুরের মাঝে ক্ষত হবার সম্ভাবনা বেশি দেখা দেয় অস্বাস্থ্যকর গোয়াল ঘর হলে রোগের সংক্রমণ বেশি হতে পারে

রোগ লক্ষণ
 আক্রান্ত প্রাণীকে আকষ্মিকভাবে খোঁড়াতে দেখা যায় সাধারণত এক পায়ে ব্যথা হলেও তা প্রায়শ মারাত্নক হয়ে থাকে দেহের তাপমাত্রা ১০৩-১০৪ ফা লক্ষ্য করা যায় ক্ষুধামান্দ্য দেখা দেয় গাভীর দৈহিক ওজন দুধ উৎপাদন হ্রাস পায় আক্রান্ত ষাঁড় সাময়িকভাবে অনুর্বর (infertile) হয়ে যেতে পারে অনেক সময় পায়ের ক্ষতে পুঁজ হয় নেক্রসিস হয়ে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দুর্গন্ধ বের হতে থাকে রোগজীবাণুর সংক্রমণের ফলে অস্থিসন্ধি, সাইনোভিয়া টেন্ডনের প্রদাহ দেখা দেয় ফলে আক্রান্ত গরু মাটিতে শুয়ে পড়ে এক্ষেত্রে আক্রান্ত গরুর চিকিৎসার ব্যবস্থা নিতে হবে যথাসময়ে চিকিৎসা না করালে ক্ষুর খসে যেতে পারে গরু স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে যায় গরু যদি কয়েক সপ্তাহ যাবৎ খোঁড়াতে থাকে তাহলে দুধ উৎপাদন দারুণভাবে কমে যায় এবং দৈহিক ওজনও হ্রাস পায় চিকিৎসার অভাবে রোগ যদি খুব জটিল আকার ধারণ করে তাহলে আক্রান্ত প্রাণীকে বাতিল ঘোষণা করতে হয়

রোগ নির্ণয়
 রোগের ইতিহাস বৈশিষ্ট্যপূর্ণ রোগলক্ষণ দেখে রোগ নির্ণয় করা যায় এছাড়া পায়ের করোনেটের ক্ষত পরীক্ষা করে রোগ সনাক্ত করা যেতে পারে
 ল্যাবরেটরিতে রোগের জীবাণু সনাক্ত করা যায় রোগজীবাণু সুনির্দিষ্টভাবে সনাক্ত করার জন্য পায়ের ক্ষত থেকে সোয়াব নিয়ে গ্রাম স্টেইন ব্লাড আগারে কালচার করে রোগের জীবাণু সনাক্ত করা যায়

রোগ সনাক্তকরণে পার্থক্য
 রোগের লিশানের স্থান, রোগের প্রকৃতি, লিশানের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দুর্গন্ধ, পালে রোগের ধরন, ঋতু আবহাওয়া পর্যালোচনা করে ফুট রটে আক্রান্ত গরুর বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায

ইন্টারডিজিটাল ডার্মাটাইটিস/স্টেবল ফুট রট
 গবাদিপশুকে আবদ্ধ অবস্থায় দীর্ঘ দিন প্রতিপালন করলে সাধারণত রোগ দেখা দিয়ে থাকে তবে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে পালন করা হলে প্রায়শ রোগ দেখা দেয় আবার পরিচ্ছন্ন পরিবেশে পালিত গরুতেও রোগ দেখা দিতে পারে রোগের কারণ ঠিক জানা না গেলেও আক্রান্ত পশু থেকে Bacteroides সনাক্ত করা গেছে
 প্রাথমিক পর্যায়ে ক্ষুরের bulb এলাকা থেকে দুর্গন্ধযুক্ত আঠালো রস নিঃসরণ হতে থাকে লিশান বেদনাদায়ক হয় কিন্তু অন্য কোনো লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা যায় না একাধিক ক্ষুর আক্রান্ত হতে পারে দীর্ঘ দিন ভুগতে থাকলে ক্ষত মারাত্নক হয় সেখানে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ঘটে স্টেবল ফুটরটে ইনজেকশনের মাধ্যমে চিকিৎসায় তেমন উপকার হয় না তবে ক্ষতস্থানে পরিচর্যা করে সেখানে ব্যাকটেরিয়ানাশক ঔষধ ব্যবহার করলে ফল পাওয়া যায়

ভেরুকোজ ডার্মাটাইটিস
 সাধারণত কাদাযুক্ত ভেজা স্থানে গাদাগাদি করে গরু পালিত হলে তাদের এরোগ হয়ে থাকে ক্ষুরের planter অঞ্চলে প্রদাহ দেখা দেয় চার পায়ের ক্ষুরই আক্রান্ত হতে পারে আক্রান্ত স্থান অত্যন্ত বেদনাদায়ক হয় গরু খোঁড়াতে থাকে আক্রান্ত স্থান থেকে smear নিয়ে পরীক্ষা করলে পর্যাপ্ত সংখ্যক F. necrophorum ব্যাকটেরিয়া সনাক্ত করা যায় রোগের চিকিৎসা হচ্ছে, আক্রান্ত স্থান জীবাণুনাশক সাবান পানি দ্বারা ভালোভাবে ধুয়ে তারপর সেখানে % কপার সালফেট সলিউশন প্রয়োগ করতে হবে এভাবে প্রতিদিন চিকিৎসা করতে হবে যখন অনেক গরু একই সাথে আক্রান্ত হয় তখন কপার সালফেটের সলিউশনের মাঝে প্রতিদিন ফুট ডিপ প্রয়োগ করতে হবে

আঘাতজনিত ক্ষত
 পায়ের ক্ষুরে কোনো ধারালো বস্তু দ্বারা ক্ষত হলে কিংবা ক্ষুর বেড়ে গেলে তা ভালোভাবে পরীক্ষা করলেই বোঝা যাবে ল্যামিনাইটিস (Laminitis) হলে গরু প্রায়শ খোঁড়া হয়ে যায় কিন্তু এসব ক্ষেত্রে কোনো লিশান পরিলক্ষিত হয় না

চিকিৎসা
 আক্রান্ত পশুদেরকে শুকনো পরিষ্কার স্থানে রাখতে হবে এ্যান্টিবায়োটিকস বা সালফোনামাইডস প্রয়োগ করতে হবে এবং ক্ষত স্থান জীবাণুনাশক দ্বারা পরিষ্কার করতে হবে চিকিৎসার জন্য প্রোকেইন পেনিসিলিন-জি প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ২২,০০০ ইউনিট হিসাবে দিনে দুইবার মাংসপেশীতে ইনজেকশন দিতে হবে
 অক্সিটেট্রাসাইক্লিন প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ১০ মিগ্রা হিসাবে দৈনিক শিরা বা মাংশপেশীতে ইনজেকশন দিতে হবে ভেড়া ছাগলের জন্য প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ৭৫ মিগ্রা স্ট্রেপটোমাইসিন এবং ৭০০০ ইউনিট প্রোকেইন পেনিসিলিন মাংসপেশীতে দিলে উপকার হয়
 সোডিয়াম সালফাডিমিডিন প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ১৫০-২০০ মিলিগ্রাম হিসাবে শিরা বা পেরিটোনিয়ামের মধ্যে ইনজেকশন দিলেও কাজ হয়
 ক্ষতস্থান ভালোভাবে জীবাণুনাশক সলিউশন দ্বারা পরিষ্কার করে এন্টিসেপ্টিক এসট্রিনজেন্ট ঔষধ প্রয়োগ করে ব্যান্ডেজ করে দেয়া যেতে পারে এছাড়াও % কপার সালফেট বা % ফরমালিন দ্বারা ক্ষত স্থান পরিষ্কার করে ১০% জিংক সালফেট ব্রাশের মাধ্যমে প্রয়োগ করলেও উপকার হয়

প্রতিরোধ ব্যবস্থা
 গরুর ক্ষুরে যেন ক্ষত না হয় সেজন্য প্রয়োজনীয় প্রতিরোধক ব্যবস্থা নিতে হবে
 গোয়াল ঘর বা খামারের প্রবেশ পথে % কপার সালফেট সলিউশন ফুট বাথ হিসাবে ব্যবহার করতে হবে এই সলিউশন দিনে দুইবার নূতন করে প্রস্তুত করে ফুট বাথ হিসাবে প্রয়োগ করতে হবে নিয়মিত এই ফুটবাথে গরু পা ডুবালে রোগের প্রাদুর্ভাব বহুলাংশে রোধ করা যাবে
 কেমোপ্রোফাইল্যাক্সিসঃ রোগের প্রাদুর্ভাবের সময় প্রতিটি গরুকে দৈনিক ৫০০ মিলিগ্রাম হিসাবে ক্লোরটেট্রাসাইক্লিন ২৮ দিন এবং পরে প্রত্যহ ৭৫ মিলিগ্রাম হিসাবে সেবন করানো হলে রোগের প্রাদুর্ভাব রোধ করা যায়
 গবাদিপশুর খাদ্যে দৈনিক ২০০-৪০০ মিলিগ্রাম অর্গানিক আয়োডাইড (ethylene diamine dihydriodide) খাওয়ানো হলে রোগের প্রতিরোধ হয়
 ভ্যাকসিন প্রয়োগঃ মিনারেল অয়েল এডজুভ্যান্ট ভ্যাকসিন প্রয়োগ করলে রোগ প্রতিরোধ করা যায়
 গবাদিপশুকে কাদা বা ভেজা স্থানে রাখা বা যাওয়া থেকে বিরত রাখতে হবে
 গোয়াল ঘর সব সময় পরিষ্কার শুকনো রাখতে হবে

অর্থনৈতিক গুরুত্ব
 ডেয়রী খামারের ক্ষেত্রে ফুট রট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তা অর্থনৈতিক দিক থেকে বিশেষ তাৎপর্য বহন করে ডেয়রী খামারের গাভী যেহেতু নিবিড়ভাবে পালিত হয় সেহেতু সেখানে রোগের প্রাদুর্ভাব প্রায়শ ব্যাপক আকারে দেখা দিয়ে থাকে খাঁটি বা সংকর জাতের গাভীতে রোগ হলে পায়ের ব্যথায় মাটিতে শুয়ে পড়ে খাদ্য কম খায় ওলান মাটির সাথে দীর্ঘ সময় লেগে থাকায় ওলানফোলা রোগের প্রাদুর্ভাব হতে পারে আক্রান্ত গাভীর দুধ উৎপাদন বহুলাংশে হ্রাস পায় কোনো কোনো সময় পায়ের সন্ধি ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে এবং পরবর্তী পর্যায়ে গাভী চলাফেরায় অক্ষম হয়ে যায় যদিও রোগে মৃত্যু ঘটে না কিন্তু বর্ণিত আনুসাঙ্গিক কারণে খামারের উৎপাদন দারুণভাবে হ্রাস পেয়ে থাকে এর ফলে খামারী অর্থনৈতিক দিক থেকে যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্থ হয়
 মাংসের জন্য পালিত ষাঁড়ের (beef cattle) খামারে রোগের প্রাদুর্ভাব হলেও খামারীর প্রভূত আর্থিক ক্ষতি হয় আক্রান্ত ষাঁড় ঠিকমতো খাদ্য গ্রহণে ব্যর্থ হওয়ায় শুকিয়ে যায় মাংস উৎপাদন হ্রাস পায়

উপসংহার
 উপরে আলোচিত নানাবিধ কারণে ফুট রট রোগ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং কারণে খামারীদেরকে গবাদিপশু পালনের প্রতি বিশেষভাবে যত্নবান হতে হবে গোয়াল ঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন শুকনো রাখা এবং নিয়মিত গবাদিপশুর সঠিক পরিচর্যা করা অত্যন্ত জরুরি সমস্ত বিধি-ব্যবস্থা নিয়মিত প্রতিপালিত হলে রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে

 লেখক: ডাঃ এফ এম রফিকুল হাসান
 গ্রুপ পাবলিকেশন ম্যানেজার, এ্যাডভান্স এনিমেল সায়েন্স কোং লিঃ
 তথ্যসূত্র: পোলট্রি, পশুসম্পদ মৎস্য বিষয়ক মাসিক পত্রিকাখামার






গাভীর রোগ-ব্যাধি তার প্রতিকার

গাভীর রোগ-ব্যাধি তার প্রতিকার
 গৃহপালিত পশুর মধ্যে গাভী পালন কৃষিজীবি সমাজের এক দীর্ঘ কালের প্রাচীন ঐতিহ্য আমাদের দেশে গাভী পালন এক সময় কেবল গ্রামের কৃষিজীবি পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল কিন্তু দুগ্ধ চাহিদা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে তা গ্রামীণ কৃষিজীবীদের সীমানা চাড়িয়ে শহরের শিক্ষিত, উচ্চবিত্ত মধ্যবিত্ত মধ্যবিত্ত পরিবার পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছে বহুদিন আগেই ছাড়া বাণিজ্যিক ভিত্তিতে দুগ্ধ খামার গড়ে উঠেছে এবং তা ক্রমেই সমপ্রসারিত হছে এটা নিঃসন্দেহে শুভ লক্ষণ ফরে উন্নত জাতের বাচুর প্রজনন এবং গাভীর যত্নের প্রয়োজনীয়তাও বেড়েছে গাভী পালনে এর পরিচচর্যা এবং রোগ-ব্যাধি সম্পর্কেও সংশ্লিষ্ট দের সচেতনতা অপরিহার্য নানা রকমের রোগে আক্রান্ত হতে পারে আপনার বাড়ি কিংবা খামারের পোষা গাভী এসব রোগ এবং এর প্রতিকার বিষয়েই এবার আলোকপাত করা যাক

ওলান পাকা রোগ
 নানা প্রকার রোগ-জীবাণু বা অন্য কোনো রাসায়নিক দ্রব্যের দ্বারা রোগের সৃষ্টি হয়

লক্ষণ
 ) ওলান লাল হয়ে ওঠে এবং হাত দিয়ে স্পর্শ করলে গরম অনুভব হয়
 ) ব্যাথার দরুণ গাভী ওলানে হাত দিতে দেয় না এবং দেহের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়
 ) হলুদ বর্ণ দুধের সাথে ছানার মতো টুকরা বের হয়
 পুরনো রোগে দুধ কমে যায় এমনকি একেবারে বন্ধ হয়ে যেতে পারে এবং ওলান শুক্ত হয়ে যায়

চিকিৎসা প্রতিকার
 প্রথমত আক্রান্ত পশুকে পরিস্কার জায়গায় রাখতে হবে ওলানে জমে থাকা দুধ বের করে দিতে হবে বাঁচের মুখ বন্ধ হয়ে গেলে টিটিসাইফন দ্বারা বাঁচের মুখ পরিস্কার করে দিতে হবে
 . ভেলুস ২০%
 . এ্যান্টিবায়েটিক
 . ম্যাসটাইটিস টিউব ইত্যাদি

পেট ফাঁপা
 সাধারণত গরহজমের জন্য গাভীর পেট ফেঁপে যায় এছাড়া কিছু কিছু রোগের কারণেও পেট ফাঁপে

চিকিৎসা প্রতিকার
 দানাদার খাদ্য বন্ধ করে দিতে হবে শুধুমাত্র শুকনা খড় খেতে দেওয়া যেতে পারে
 . নিওমেট্রিল
 . কারমিনেটিভ মিঙ্চার ইত্যাদি

জায়রিয়া বা পাতলা পায়খানা
 অনেক রোগের দরুন পাতলা পায়খানা হয়ে থাকে তবে অস্ত্রর রোগ এদের মধ্যে অন্যতম আক্রান্ত পশু দূর্বল হয়ে পড়ে

চিকিৎসা প্রতিকার
 . সকেটিল পাউডার
 . স্টিনামিন ট্যাবলেট ইত্যাদি

নিউমোনিয়া
 ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গাস, রাসায়নিক দ্রবাদি, ঠান্ডা ইত্যাদির কারণে পশুর নিউমোনিয়া হতে পারে

লক্ষণ
 ) ঘনঘন নিঃশ্বাস রোগের প্রধান লক্ষণ
 ) রোগের শেষ পর্যায়ে শ্বাসকষ্ট হয়
 ) শুল্ক কাশি হতে পারে
 ) তীব্র রোগে জ্বর হয় এবং নাক দিয়ে সর্দি পড়ে
 ) বুকের মধ্যে গরগর শব্দ হয়

চিকিৎসা প্রতিকার
  ভেলুসং ২০%
  অ্যান্টিবায়টিক
  ক্লোরেটেট্রাসন
  টেরামাইসিন
  ভেটিবেনজামিন

কৃমি
 কৃমি নানা জাতের নানা আকারের হয়ে থাকে কৃমিতে আক্রান্ত পশুকে ঠিক মতো খাবার দিলেও তার স্বাস্থ্যের কোন উন্নতি হয় না বরং দি দিন রোগা হতে থাকে

লক্ষণ
 ) পশু দূর্বল হয়ে যায়
 ) খাওয়া-দাওয়া কমিয়ে দেয়
 ) হাড্ডিসার হয়ে যায়
 ) সময় সময় পায়খানা পাতলা হয়
 ) শরীরের ওজন কমে যায়
 ) দুগ্ধবর্তী গাভীর দুধ কমে যায়
 ) রক্তশুণ্যতায় ভোগে বলে সহজেই অন্যান্য আক্রান্ত হওয়ার আশংকা থাকে
 ) দেহের স্বাভাবিক পুষ্টি বৃদ্ধি পায় না
 ) ফলে পশুকে রোগা আকারে ছোট দেখায়

চিকিৎসা প্রতিকার
 গোবর পরীক্ষান্তে কৃমিনাশক ওষুধ দ্বারা চিকিৎসা করতে হবে

লক্ষণ
প্রাথমিক অবস্থায়
 ) আক্রান্ত পশু কিছু খেতে চায় না
 ) হাটতে চায় না
 ) জিহবা বের হয়ে থাকে
 ) মাথা পায়ের মাংসপেশী কাপতে থাকে

পরবর্তী অবস্থায় আক্রান্ত গাভী
 ) বুকে ভর দিয়ে শুয়ে পড়ে
 ) মাথা বাঁকিয়ে এক পাশে কাধের ওপর ফেলে রাখে
 ) অবস্থায় গাভী অনেকটা চৈতন্য হারিয়ে ফেলে
 ) গাভী কাত হয়ে শুয়ে পড়ে, উঠতে পারে না
 ) ধমনীর মাত্রা বেড়ে যায়
 ) অবশেষে গাভী মারা যায়

চিকিৎসা প্রতিকার
 গাভীকে প্রয়োজনীয় পরিমাণ ক্যালসিয়াম ইনজেকশন দিতে পারলে দ্রুত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করা যাবে

কিটোসিস
 দেহের মধ্যে শর্করা জাতীয় খাদ্যের বিপাকক্রিয়ার কোন প্রকার বিঘ্ন ঘটলে রক্তে এসিটোন বা কিটোন নামক বিষাক্ত দ্রব্য অধিক মাত্রায় জমা হয়ে দেহ বিষিয়ে তোলে এই বিষক্রিয়ার ফলেই কিটোসিস রোগের সৃষ্টি হয়

লক্ষণ
 ) ক্ষুধামন্দা দেখা দেয়
 ) গাভীর দুধ কমে যায়
 ) দৈহিক ওজন কমে যায়
 ) কোষ্ঠাকাঠিন্য দেখা দেয়
 ) এছাড়া আক্রান্ত পশুর নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে এসিটোনের মিষ্টি গন্ধ পাওয়া যায়
 ) অনেক সময় গাভী এক জায়গায় দাঁড়িয়ে চতুর্দিকে ঘোরে

চিকিৎসা প্রতিকার
 অপটিকরটেনল-এস ইনজেকশন

ফুল আটকে যাওয়া
 বাচ্চা প্রসবের পর অনেক সময় নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফুল বের হয়ে আসে না এবং এসব ক্ষেত্রে গর্ভ ফুলের অংশ বিশেষ বাইরের দিক হতে ঝুলে থাকতে দেখা যায়

চিকিৎসা প্রতিকার
  অকসিটোসিন
  ইউটোসিল পেশারিস
  এ্যানটবায়েটিক ইনজেকশন ইত্যাদি

জলুবায়ুর প্রদাহ
 অধিকাংশ ক্ষেত্রে রোগের জীবাণূ যোনিপথ হতে জরায়ুতে পৌছে রোগ হতে পারে গর্ভ ফুলের টুকরা ভেতরে থেকে গেলে পচে যায় এবং প্রদাহের কারণ ঘটায় কামপর্বে পশুর যৌন-ক্রিয়ার সয়ও অনেক সময় জরায়ুতে রোগ জীবানূ সংক্রমিত হয়ে থাকে

লক্ষণ
 ) জ্বর হয়
 ) দুর্গন্ধযুক্ত জলের মতো কিংবা কালচে লাল রঙের স্রাব পড়তে দেখা যায়
 ) খাদ্যে অরুচি হয়
 ) দুধ কমে যায়
 ) গাভী পাল রাখে না

চিকিৎসা প্রতিকার
  ইউটোলিস পেরারিস
  এ্যান্টিবায়েটিক ইনজেকশন ইত্যাদি

গর্ভপাত
 সাধারণত রোগ-জীবানুর কারণেই অধিকাংশ গর্ভপাত হয়ে থাকে এছাড়া আঘাত, বিষক্রিয়া, পক্ষাঘাত ইত্যাদি কারণেও গর্ভপাত হতে পারে

চিকিৎসা প্রতিকার
  ইউটোসিল পেশারিশ
  এ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন ইত্যাদি

অনুর্বরতা সাময়িক বন্ধ্যাত্ব
 সাধারণত প্রজনন ইন্দ্রিয়সমূহের বিভিন্ন সংক্রামক ব্যাধি, হরমোন ক্ষরণের অনিয়ম, অসমতা, ওভারিতে সিস্ট পুষ্টিহীনতা ইত্যাদি কারণে সাময়িক বন্ধ্যাত্ব রোগ হয়ে থাকে

চিকিৎসা প্রতিকার
 সঠিক কারণ নির্ধারণ করে হরমোন দ্বাা চিকিৎসা করলে সাময়িক বন্ধ্যাত্ব দূর হয় যৌননালীর অসুখের দরুন বন্ধ্যাত্ব হলে ইউটোলিস পেশারিস, স্টিমাভেট ট্যাবলেট জরায়ুতে স্থাপন করতে হবে ভিটামিন '' যুক্ত সুষম পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে

খুরো বা খুর পচা
 খুরের ভিতরের বা চারপাশের টিস্যু পচনশীল অবস্থাকে ফুটরট বলে

লক্ষণ
 ) আঘাতপ্রাপ্ত টিস্যুতে পচন যুক্ত ঘা হয়
 ) আশপাশের টিস্যুতে রক্ত জমা হতে দেখা যায়
 ) পশু খুড়িয়ে হাঁটে এবং কিছু খেতে চায় না
 ) পশুর ওজন দুধ কমে যায়
 ) শরীরে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়

চিকিৎসা প্রতিকার
  ভেসাডিন
  ভেসুলাং ২০% ইনজেকশন
  এ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন
  ক্ষতস্থান ভালভাবে পরিস্কার করে দিনে বার ডাস্টিং পাউডার ব্যবহার করতে হবে

ককসিডিওসিস বা রক্ত আমাশয়
 রক্ত মিশানো পাতলা পায়খানা, রক্ত শূণ্যতা শরীরের দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্তি রোগের প্রধান বৈশিষ্ট্য

লক্ষণ
 ) শরীরের তাপমাত্রা অল্প বৃদ্ধি পায়
 ) হঠাৎ করে পায়খানা শুরু হয়
 ) পায়খানার সময় ঘন ঘন কোথ দেয়
 ) পায়খানা খুবই দুগর্ন্ধযুক্ত
 ) আক্রান্ত পশু দিন দিন দূর্বল হতে থাকে
 ) মলের সাথে মিউকাস অথবা চাকা চাকা রক্ত থাকে
 ) খেতে চায় না
 ) শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়

চিকিৎসা প্রতিকার
  ভেলুসং ২০% ইনজেকশন
  সকেটিল পাউডার ইত্যাদি

বেবিসিয়াসিস বা রক্ত প্রস্রাব
 আটালি দ্বারা রোগের জীবাণূ সংক্রামিত হয়

লক্ষণ
 ) হঠাৎ জ্বর (১০৮ ডিগ্রী ফা.) হয়
 ) জাবর কাটা বন্ধ করে দেয়
 ) রক্তের সঙ্গে লোহিত কাণিকা ডাঙ্গা হিমোব্লোবিন যুক্ত হবে প্রস্রাবের সাথে বের হয়ে আসে
 ) প্রস্রাবের রঙ লাল হয়

প্রতিকার চিকিৎসা
  বেরিনিণ ইনজেকশন
  শরীরের আটালিমুক্ত করার জন্য নেগুভন সপ্রে অথবা আসানটল সপ্রে দিতে হবে

উকুন/আটালি
 এরা এক প্রকার বহিঃ পরজীবী অধিকাংশ গবাদি পশু উকুন/ আটালি দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকে

চিকিৎসা প্রতিকার
  নিওসিডল ৪০ ডবি্লউ-পি
  আসানটল
  নেগুভন সপ্রে ইত্যাদি মিশিয়ে পশুর গায়ের সপ্রে করতে হবে
তথ্য সূত্র: শাইখ সিরাজ রচিতমাটি মানুষের চাষবাসগ্রন্থ থেকে সংগ্রহীত


অ্যানথ্রাক্স রোগ, লক্ষণ ও প্রতিকার

অ্যানথ্রাক্স গবাদিপশুর একটি মারাত্মক সংক্রামক রোগ। গবাদিপশু থেকে এ রোগে মানুষেও ছড়ায়। এ রোগের জীবাণু দ্বারা সংক্রামিত খাদ্য খেয়ে বিশেষ করে বর্ষাকালে নদী-নালার পানি ও জলাবদ্ধ জায়গার ঘাস খেয়ে গবাদিপশু অ্যানথ্রাক্স রোগে আক্রান্ত হয়।

 রাতে গোয়াল ঘরে সুস্খ গরু রেখে এসে সকালে গিয়ে যদি দেখা যায় গরু মরে চিৎ হয়ে পড়ে আছে তাহলে যেসব রোগে মারা যেতে পারে বলে মনে করা হয় অ্যানথ্রাক্স বা তড়কা রোগ তার মধ্যে অন্যতম। রোগের লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে গরু মারা যায়। অনেক সময় লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার পরপরই গরু মারা যেতে পারে। চিকিৎসার কোনো সুযোগই পাওয়া যায় না। এমনই ঘাতক ব্যাধি অ্যানথ্রাক্স বা তড়কা রোগ। সম্প্রতি সিরাজগঞ্জ এবং পাবনার কয়েকটি থানায় এ রোগটি দেখা দিয়েছে। আক্রান্ত হয়েছে অনেক গরু, মারাও গেছে বেশ কিছু। সিরাজগঞ্জ বা পাবনায়ই যে এ রোগ প্রথম দেখা দিয়েছে তা নয়। অ্যানথ্রাক্স বা তড়কা রোগের ইতিহাস অনেক পুরনো। খ্রিষ্টপূর্ব ১৪৯১ সালেও মিসরে এ রোগের প্রাদুর্ভাব ছিল বলে জানা যায়। শুধু মিসর নয়, গ্রিস, রোম এমনকি ভারতবর্ষেও এ রোগের প্রাদুর্ভাব ছিল। সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুতে ইউরোপে এ রোগ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে আমেরিকায় ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়ার রেকর্ড রয়েছে। এমনকি মাত্র তিন দশক আগে ১৯৭৮-৮০ সালে জিম্বাবুয়েতে ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়েছিল। এতে শুধু পশু নয়, প্রায় দশ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়, মারা যায় প্রায় ১৫১ জন।

যেসব প্রাণীর এ রোগ হয়: মূলত গরু এ রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। তবে ছাগল, ভেড়া, ঘোড়া, মহিষ, জেব্রা, জিরাফ, হরিণ, শূকর, হাতি এবং বানরও এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। প্রাণী থেকে মানুষে এ রোগ ছড়ায় বলে একে জ্যুনোটিক ডিজিজও (zoonotic disease) বলে। তাই ভয়ের কারণ একটু বেশি।

কিভাবে ছড়ায় : মৃত বা আক্রান্ত পশুর লালা বা রক্তের মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায়। তা ছাড়া চুল, উল বা অন্যান্য বর্জের মাধ্যমেও ছড়াতে পারে। মৃত পশু পচে গলে মাটিতে মিশে গেলেও হাড় যদি থাকে তবে তা থেকেও ছড়াতে পারে। এ রোগের জীবাণু প্রচণ্ড প্রতিকূল পরিবেশেও বছরের পর বছর বেঁচে থাকতে পারে। কখনো এক দশকও। কোথাও একবার এ রোগ দেখা দিলে তা পরবর্তী সময়ে আবারো দেখা দিতে পারে। ট্যানারি বর্জ্যরে সঠিক ও সুষ্ঠু নিষ্কাশন এ জন্যই খুব গুরুত্বপূর্ণ। অ্যানথ্রাক্সে মৃত গরুর চামড়া ট্যানারিতে গেলে তা থেকে জীবাণু চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে পারে। ভয়াবহ অবস্খার সৃষ্টি হওয়া খুব অস্বাভাবিক নয়।

রোগটি কেন এত মারাত্মক : এ রোগের জন্য দায়ী ব্যাসিলাস অ্যাথ্রাসিস (Bacillus anthracis) নামের এক ধরনের ব্যাক্টেরিয়া। এই ব্যাক্টেরিয়া বিশেষ ধরনের কিছু টক্সিন বা বিষাণু তৈরি করতে পারে। এ টক্সিন প্রাণীদেহে প্রবেশের দুই থেকে চার ঘন্টার মধ্যে প্রাণীদেহের নিউট্রোফিলকে দুর্বল করে ফেলে। নিউট্রোফিল হচ্ছে এক ধরনের শ্বেতকণিকা যা বাইরের জীবাণুর আক্রমণ থেকে দেহকে রক্ষা করে। টক্সিন নিউট্রোফিলের ফিলামেন্ট তৈরিতে বাধা দেয়, ফলে নিউট্রোফিল চলৎ-শক্তি হারিয়ে ফেলে। সংক্রমণের স্খানে যেতে পারে না, ব্যাক্টেরিয়াকে ধ্বংসও করতে পারে না।

 নিউট্রোফিল নিষ্ক্রিয় হওয়ায় ব্যাক্টেরিয়া বাধাহীনভাবে দ্রুত দেহে ছড়িয়ে পড়ে এবং রোগ তৈরি করে মৃত্যু ঘটায়।
রোগের লক্ষণ : লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার আগেই সাধারণত গরু মারা যায়। তবে লক্ষণ হিসেবে কখনো কখনো গরুর খিঁচুনি, কাঁপুনি দেখা দেয়। শরীরের তাপমাত্রা খুব বেড়ে যায়। তাপমাত্রা প্রায় ১০৫-১০৭ ডিগ্রি পর্যন্ত হতে পারে। গরু ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে, শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে। খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকে। চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে গরু মারা যায়। মারা গেলে নাক, মুখ, কান, মলদ্বার দিয়ে কালচে লাল রঙের রক্ত বের হয়। এ রোগের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে গরু মারা যাওয়ার পরও রক্ত কখনো জমাট বাঁধে না।

লক্ষণসমূহ: ক. অত্যাধিক জ্বর হয় (১০৩-১০৭ ফাঃ);
 খ. শ্বাসকষ্ট এবং দাঁত কটকট করে;
 গ. শরীরের লোম খাড়া হয়ে উঠে;
 ঘ. আক্রান্ত পশু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে;
 ঙ. পশুকে কিছুটা উত্তেজিত দেখায়;
 চ. পশু নিস্তেজ হয়ে শুয়ে পড়ে;
 ছ. খিঁচুনি হয় ও অবশেষে পশু মারা যায়;
 জ. মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে বা পরে পশুর নাক, মুখ, মলদ্বার ইত্যাদি দিয়ে কালো রক্ত নির্গত হয়;
 ঝ. অনেক সময় লক্ষণসমূহ প্রকাশের আগেই পশুর মৃত্যু ঘটে।

রোগ নির্ণয় : রোগের লক্ষণ দেখে সহজেই রোগ নির্ণয় করা যায়। তাছাড়া রক্ত পরীক্ষা করলে ছোট দণ্ডের মতো ব্যাক্টেরিয়া দেখতে পাওয়া যায়। এ রোগে মৃত গরুর ময়নাতদন্ত করা হয় না। তবে ভুলক্রমে ময়নাতদন্ত করে ফেললে দেখা যায় প্লীহা বড় হয়ে গেছে।

চিকিৎসা : সাধারণত চিকিৎসা করার কোনো সুযোগ পাওয়া যায় না, তার আগেই আক্রান্ত গরু মারা যায়। যদি কখনো আক্রান্ত গরু পাওয়া যায় তবে উচ্চমাত্রার পেনিসিলিন, স্ট্রেপটোমাইসিন, টেট্রাসাইক্লিন জাতীয় অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করা যেতে পারে। ভ্যাকসিন দেয়াই এ রোগ প্রতিরোধের একমাত্র উপায়। লাইভ এবং কিলড উভয় ধরনের ভ্যাকসিনই পাওয়া যায়। চামড়ার নিচে এ ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়। ভ্যাকসিন প্রয়োগের ১০-১৫ দিনের মধ্যেই গরুর দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়। আক্রান্ত গরুতে আগে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়ে থাকলে নতুন করে ভ্যাকসিন দেয়ার প্রয়োজন হয় না।

প্রতিরোধে যা করণীয় : খুবই ভয়ানক আর ছোঁয়াচে রোগ হওয়ায় এ রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাই এ রোগ প্রতিরোধে বিশেষভাবে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। এ জন্য নিচের নির্দেশনাগুলো মেনে চলা জরুরি।

 ১. অ্যানথ্রাক্স রোগে মৃত পশুর ময়নাতদন্ত করা একেবারেই অনুচিত। রোগের লক্ষণ এবং রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমেই এ রোগ সম্বìেধ শতভাগ নিশ্চিত হওয়া সম্ভব। ময়নাতদন্তে কাটাছেঁড়া করার জন্য যে ধরনের সতর্কতামূলক ব্যবস্খা গ্রহণ করা প্রয়োজন দেশের কোনো ল্যাবরেটরিতেই সে ধরনের ব্যবস্খা নেই। কাটাছেঁড়া করতে গিয়ে পশুর রক্ত, বর্জ্য চার দিকে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। আশঙ্কা রয়েছে যারা কাটাছেঁড়া করবেন তাদেরই এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার।

 ২. পশুর মৃতদেহ ভাগাড়, নদী, জলাশয়, জঙ্গল বা পরিত্যক্ত জায়গায় ফেলা যাবে না। এতে শেয়াল, কুকুর, শকুনসহ মৃতদেহ ভক্ষণকারী অন্যান্য প্রাণী সেগুলো খাবে এবং রোগজীবাণু চার দিকে ছড়িয়ে যাবে। সেই সাথে বাতাস, পানির মাধ্যমেও গোটা এলাকায় ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

 ৩. মৃতদেহ লোকালয় থেকে দূরে জনমানবহীন নির্জন জায়গায় আট-দশ ফুট গর্ত খুঁড়ে মাটি চাপা দেয়ার ব্যবস্খা করতে হবে। প্রথমে গর্তে কিছু চুন ছড়িয়ে দিতে হবে। মৃতদেহ রেখে আবার কিছু চুন প্রয়োগ করে মাটি চাপা দিতে হবে। কুকুর, শেয়াল যেন মাটি খুঁড়ে মৃতদেহ বের করে নিয়ে যেতে না পারে সে জন্য গর্তের ওপর পাথর দিয়ে রাখা ভালো। গর্তের চার পাশে কাঁটা দিয়ে রাখলে কুকুর, শেয়াল কাছে ঘেঁষতে পারবে না।

 ৪. বাড়ি থেকে মৃতদেহ বহন করে নেয়ার সময় বিশেষ সতর্কতামূলক ব্যবস্খা গ্রহণ করা প্রয়োজন। অ্যানথ্রাক্সে মৃত পশুর নাক, মুখ, কান, মলদ্বার দিয়ে রক্ত বের হয়ে থাকে। এ রক্ত আবার জমাট বাঁধা থাকে না। ফলে আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যেতে পারে। তাতে সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই মৃত পশুর নাক, মুখ, কান, মলদ্বারে তুলা বা কাপড় গুঁজে ভ্যান বা বহনকারী বাহনে উঠাতে হবে। ভ্যান বা অন্য কোনো বাহনে পলিথিন বা অন্য কিছু এমনভাবে দিয়ে নিতে হবে যাতে দুর্ঘটনাবশত লালা বা রক্ত পড়লেও যেন ভ্যান বা বাহনে না লাগে। যারা মৃতদেহ বহন করবে তাদের অবশ্যই দস্তানাসহ বিশেষ ধরনের পোশাক পরা প্রয়োজন।

 ৫. মৃত পশুর চামড়া ছাড়ানো যাবে না।

 ৬. আক্রান্ত গরু জবাই করা যাবে না। গোশত না খাওয়াই উত্তম।

 ৭. আক্রান্ত বা মৃত গরুর গোয়ালঘর ব্লিচিং পাউডার, কাপড় কাচার সোডা বা পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেট দিয়ে যত্নের সাথে ধুয়ে পরিষ্কার করতে হবে। আক্রান্ত গরু সুস্খ গরু থেকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে রাখতে হবে। কারণ আক্রান্ত গরু থেকে জীবাণু সুস্খ গরুতে ছড়াতে পারে। এসব নির্দেশনা সঠিকভাবে মেনে চললে রোগের বিস্তার রোধ করা সম্ভব হবে।

আশার কথা : আশার কথা হচ্ছে Bacillus anthracis জীবাণু ধ্বংসের খুব কার্যকরী একটি প্রোটিন আলফা ডিফেনসিন (Alpha defensin) শনাক্ত করতে পেরেছেন জার্মানির ম্যাক্স প্লাংক ইনস্টিটিউটের গবেষকরা। নিউট্রিফিল যেসব প্রোটিন উৎপন্ন করে Alpha defensin তার মধ্যে একটি। এ নিয়ে গবেষণা চলছে, অদূর ভবিষ্যতে হয়তো অ্যানথ্রাক্সের কার্যকর ওষুধ বাজারে আসবে। গুটিবসন্তের মতো ঘাতক ব্যাধি অ্যানথ্রাক্সও একদিন হারিয়ে যাবে পৃথিবী থেকে, সে দিন হয়তো খুব কাছেই।

প্রতিকার: ক. গবাদিপশুকে নিয়মিত বছরে একবার অ্যানথ্রাক্স রোগের টিকা দিতে হবে;
 খ. পশুর ঘর সবসময় পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে;
 গ. মৃত পশুর দেহ, গোবর, লালা, প্রস্রাব, রক্ত ইত্যাদিসহ গভীর গর্তে পুঁতে অথবা পুড়িয়ে ফেলতে হবে;
 ঘ. কোনো পশু আক্রান্ত হলে তাকে পৃথক করে চিকিৎসা দিতে হবে;
 ঙ. মৃত পশুর চামড়া ছাড়ানো যাবে না;
 চ. নদী-নালার পানি ও নিচু এলাকার ঘাস খাওয়ানো যাবে না।
 ছ. অ্যানথ্রাক্স রোগে আক্রান্ত পশুর মাংস কোনো অবস্থাতেই খাওয়া যাবে না।

অ্যানথ্রাক্স রোগে মানুষ আক্রান্ত হবার লক্ষণসমূহ : অ্যানথ্রাক্স রোগে আক্রান্ত গবাদিপশু যারা জবাই করেন, মাংস কাটেন, মাংস ধোয়ামোছা করেন, চামড়া ছাড়ান এবং খান প্রত্যেকেই এই রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। অ্যানথ্র্যাক্স একটি ব্যাকটেরিয়া (ব্যাসিলাস অ্যানথ্র্যাসিস) জনিত সংক্রামক রোগ। রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা দিতে হয়, না হলে প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে।

কিভাবে ছড়ায় : আক্রান্ত পশুর (গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ) লোম, চামড়া, মাংস রোগ ছড়ানোর উৎস হিসেবে গণ্য করা। এ জন্য রোগে আক্রান্ত পশুর খামারি, লোম উত্তোলনকারী এবং কসাইরা প্রথমে আক্রান্ত হয়ে থাকে। কখনোই রোগাক্রান্ত ব্যক্তির মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায় না। তবে আক্রান্ত পশুর মাংস ও রক্তের সংস্পর্শে এ রোগ ছড়াতে পারে। তাই রোগাক্রান্ত পশু জবাই বা খাদ্য হিসেবে গ্রহণের অনুপযোগী।

লক্ষণ কি : সাধারণত জীবাণু শরীরে প্রবেশের দুই থেকে পাঁচ দিনের মধ্যেই লক্ষণ প্রকাশ পেয়ে থাকে। সর্বপ্রথম ত্বকেই এ রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়, আক্রান্ত স্থান চুলকায় এবং লাল বর্ণের হয়ে থাকে, যা প্রাথমিকভাবে পোকার কামড় মনে হতে পারে। এটি শুকিয়ে লালচে কালো বর্ণের আকার ধারণ করে এবং খসে পড়ে। ক্ষতটির কেন্দ্র শুকনা এবং কালো, তার চারদিকে উঁচু এবং লাল বর্ণের হয়ে থাকে।

লক্ষণসমূহ:  ক. আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে জ্বর উঠবে;
 খ. চামড়ায় প্রথমে লালচে দাগ হবে এবং আক্রান্ত স্থান চুলকাবে;
 গ. পরবর্তীতে আক্রান্ত স্থানে প্রায় দেড় দুই ইঞ্চি পরিমাণে ফোসকা উঠবে, ফোসকার মাঝখানে পচনের মত কালচে হবে;
 ঘ. ফোসকার স্থানে পরে ব্যথামুক্ত ঘা হবে। আক্রান্ত ব্যক্তি সঠিকভাবে চিকিৎসা না নিলে মারা যেতে পারে।

জটিলতা : ত্বকে লক্ষণ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা গ্রহণ করলে এটি সহজে নিরাময়যোগ্য রোগ কিন্তু পরবর্তীতে শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়লে এ রোগে মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে। ব্যাকটেরিয়াজনিত প্রদাহের কারণে, উঁচু মাত্রার জ্বর, ফুসফুসের সংক্রমণের কারণে তীব্র শ্বাসকষ্ট এবং পরিপাকতন্ত্রের জটিলতার কারণে মৃত্যু হয়ে থাকে।

রোগের ধরন : অ্যানথ্রাক্স জীবাণু মানুষের দেহের বিভিন্ন অঙ্গ আক্রান্ত করতে পারে এবং আক্রান্ত অঙ্গ অনুযায়ী রোগের ধরনও বিভিন্ন রকম হয়। যেমন :

১। ত্বকের (cuteneous) অ্যানথ্রাক্স : অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত পশু অথবা এনথ্রাক্স স্পোর দ্বারা দূষিত পশুর পশম, চুল বা চামড়ার সংস্পর্শে এলে অ্যানথ্রাক্স স্পোর মানুষের ত্বকের অতিসূক্ষ্ম ক্ষত দিয়েও প্রবেশ করতে পারে। এ অবস্থায় সাধারণত ১ থেকে ৭ দিনের মধ্যে ত্বকের ক্ষত তৈরি হয়। ক্ষত দুই হাতে মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, তবে ঘাড় এবং মাথাও আক্রান্ত হতে পারে। ত্বকে ধীরে ধীরে ঘা তৈরি হয় যা ২-৩ সেমি আয়তনের হয়ে থাকে এবং ঘা এর চারদিকের ত্বক একটু উঁচু হয়ে থাকে। ক্ষতে চুলকানি থাকে তবে ব্যথা থাকে না।

শ্বসনতন্ত্রির (inhalational) অ্যানথ্রাক্স : অ্যানথ্রাক্স জীবাণুর স্পোর যদি শ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসে প্রবেশ করলে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। শুরুর দিকে হালকা জ্বর, খুশখুশে কাশি এবং বুকে অল্প ব্যথা হয়। পরবর্তীতে তীব্র জ্বর, শ্বাসকষ্ট, শরীর নীল হয়ে যাওয়া, শরীর বেশি ঘেমে যাওয়া, কাশির সঙ্গে রক্ত বের হওয়া, বুকে ব্যথা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেয়।

মুখবিবরীয় (oropharyngeal) অ্যানথ্রাক্স : অ্যানথ্রাক্স স্পোর খেলে এ অবস্থা দেখা দেয়। গলাব্যথা, খাবার গিলতে অসুবিধা হওয়া এর লক্ষণ। এক্ষেত্রে মুখের তালু বা মুখবিবরে (pharynx) ক্ষত দেখা দেয়।

পরিপাকতন্ত্রের (Intestinal) অ্যানথ্রাক্স : এটাও অ্যানথ্রাক্স স্পোর খেলে দেখা দেয়। বমি অথবা বমিবমি ভাব, অস্বস্তি, পেটব্যথা, রক্তবমি, বারবার রক্তযুক্ত পায়খানা হওয়ার সঙ্গে জ্বর হয়।

রোগের পরিণতি : বেশির ভাগ এনথ্রাক্স ত্বকের এনথ্রাক্স, যা চিকিৎসা করলে, এমনকি চিকিৎসা না করলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভালো হয়ে যায়। অন্যান্য ধরনের এনথ্রাক্সের পরিণতি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খারাপ। এর মধ্যে সেপটিসেমিক এনথ্রাক্স এবং অ্যানথ্রাক্স মেনিনজাইটিস এ মৃত্যুহার খুবই বেশি। শ্বসনতন্ত্রের অ্যানথ্রাক্স চিকিৎসা করলেও মৃত্যুহার প্রায় ৪৫%। পরিপাকতন্ত্রের অ্যানথ্রাক্স নির্ণয় করা খুব কঠিন এবং এতে মৃত্যহার ২০-৬০%।

রোগ নির্ণয় : ত্বকের অ্যানথ্রাক্স রোগীর গবাদিপশুর সংস্পর্শে আসার ইতিহাস এবং ক্ষতের ধরন দেখেই বোঝা যায়। নিশ্চিত হওয়ার জন্য ক্ষত থেকে রস নিয়ে নির্দিষ্ট উপায়ে অণুবীক্ষণ যন্ত্রে পরীক্ষা করলে জীবাণু দেখা যায়। শ্বাসতন্ত্রের রোগ সন্দেহ করলে বুকের এক্স-রে, সিটি স্ক্যান করা হয়। সেপটিসেমিক অ্যানথ্রাক্স নির্ণয় করার জন্য ব্লাড কালচার করা হয়। মেইনজাইটিস সন্দেহ হলে লাম্বার পাংকচার করে সেরিব্রোস্পাইনাল রস পরীক্ষা করা হয়। এছাড়া ELISA নামক পরীক্ষাও এ রোগ নির্ণয়ে ব্যবহৃত হয়।

চিকিৎসা : ত্বকের সংক্রমণের ক্ষেত্রে রোগীকে বহিঃবিভাগেই চিকিৎসা দেওয়া যায়। অন্যান্য ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে হাসপাতালে ভর্তির মাধ্যমে চিকিৎসা দিতে হবে। বিভিন্ন রকমের এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা যেতে পারে, তবে অ্যানথ্রাক্স রোগের চিকিৎসায় পেনিসিলিনকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। কুইনোলন গ্রুপের এন্টিবায়োটিক যেমন : সিপ্রোফ্লক্সাসিন, লেভোফ্লক্সাসিন, গ্যাটিফ্লক্সাসিন, ডক্সিসাইক্লিন, এমক্সিসিলিন, এম্পিসিলিন, ক্লোরামফেনিকল ইত্যাদি চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।

প্রতিরোধ : ১. রোগাক্রান্ত পশুকে প্রথমেই আলাদা জায়গায় রাখতে হবে।
 ২. রোগাক্রান্ত পশুকে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা প্রদান করতে হবে।
 ৩. মৃত পশুকে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে।
 ৪. রোগাক্রান্ত পশুকে জবাই করে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না।
 ৫. রোগাক্রান্ত ব্যক্তিকে যতদ্রুত সম্ভব চিকিৎসা প্রদান করতে হবে।
অ্যানথ্রাক্স প্রতিরোধে খামারিদের করণীয়

অ্যানথ্রাক্স সাধারণত দুরকমের হয়ে থাকে। এর একটি হলো তীব্র প্রকৃতির এবং অপরটি অতি তীব্র প্রকৃতির। তীব্র প্রকৃতির রোগে আক্রান্ত প্রাণি প্রায় ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত জীবিত থাকে। জ্বর (১০৪-১০৭০ ফারেনহাইট), ক্ষুধামন্দা, নিস্তেজতা, অগভীর ও দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস এবং হৃদপিন্ডের গতি বৃদ্ধি, পেট ফাপা, দেহের কাঁপুনি, চোখের রক্তাভ পর্দা, রক্ত মিশ্রিত পাতলা মলত্যাগ ইত্যাদি উপসর্গ প্রকাশ পায়। গর্ভবতী গাভীর গর্ভপাত ঘটে। অনেক সময় নাক, মুখ, প্রস্রাব ও মলদ্বারা রক্ত ক্ষরণও হয়। দুগ্ধবতী গাভী দুধ দেয়া কমিয়ে দেয় ও দুধ হলুদ এবং রক্তমিশ্রিত দেখায়। পাকাস্ত্রে আক্রান্তের ক্ষেত্রে ডায়রিয়া ও ডিসেন্ট্রি দেখা দেয়। চিকিত্সা করা না হলে ২ থেকে ৩ দিনের মধ্যে প্রাণির মৃত্যু ঘটে। অতি তীব্র প্রকৃতির রোগ হলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনো উপসর্গ প্রকাশের আগেই আক্রান্ত প্রাণির মৃত্যু ঘটে। তবে অনেক সময় ১-২ ঘণ্টা স্থায়ী হয়। ক্লিনিক্যাল পরীক্ষার সময় পাওয়া গেলে জ্বর, পেশীর কস্পন, শ্বাসকষ্ট, মিউকোসায় রক্ত সঞ্চায়ন ইত্যাদি উপসর্গ থাকে। শেষ পর্যন্ত খিচুনি দিয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যে পশুর মৃত্যু ঘটে। মৃত পশুর স্বাভাবিক ছিদ্র দিয়ে বিশেষ করে যোনিমুখ, মলদ্বারা, নাসারন্ধ্র, মুখ ইত্যাদি দিয়ে কালচে রক্ত বের হয়। মৃত্যুর আগে দেহে জ্বর থাকে । প্রধানত তৃণভোজী প্রাণি এ রোগে আক্রান্ত হয়।

 অ্যানথ্রাক্স রোগের চিকিত্সায় এন্টিসিরাম ও এন্টিবায়োটিক ওষুধ ভালো কাজ করে। এন্টিসিরাম পাওয়া গেলে ১০০-২৫০ মি. লিটার হিসেবে প্রতিটি আক্রান্ত গরুকে নিয়মিত সিরায় ইনজেকশন দিতে হবে। তবে এ রোগে পেনিসিলিন বা অক্সিটেট্রাসাইক্লিন চিকিত্সায় অধিক সুফল পাওয়া যায়। প্রতিকেজি দৌহিক ওজনের জন্য পেনিসিলিন সাধারণত ১০০০০ ইউনিট হিসেবে দিনে দুবার মাংসে ইনজেকশন দিতে হয়। প্রতি আক্রান্ত গরুকে দিনে ৮-১০ মি. গ্রাম/কেজি দৈহিক ওজনে স্ট্রেপ্টোমাইসিন দুদিন মাংসপেশিতে ইনজেকশন দিয়ে পেনিসিলিনের চেয়ে বেশি সুফল পাওয়া গেছে।

 টিকা প্রয়োগ আক্রান্ত প্রাণিকে চিকিত্সা ও সুস্থ প্রাণিকে টিকার ব্যবস্থা করতে হবে। ঢাকার মহাখালীতে অবস্থিত প্রাণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান এ রোগ প্রতিরোধক টিকা প্রস্তুত করে। এ টিকার মাত্রা হলো, গরু-মহিষ ও ঘোড়ার ক্ষেত্রে ১ মিলিমিটার এবং মেষ, ছাগল ও শুকরের ক্ষেত্রে ০.৫ মিলিমিটার। টিকা প্রয়োগের সময় টিকার বোতল প্রথমে ভালো করে ঝাঁকিয়ে নিতে হবে। পরে জীবাণুমুক্ত সিরিঞ্জের নির্দিষ্ট মাত্রার টিকা নিয়ে প্রাণির ঘাড়ের চামড়ার নিচে ইনজেকশন দিতে হবে। আবদ্ধ বোতলে মাটির মধ্যে এ স্পোর ৬০ বছর পর্যন্ত টিকে থাকার তথ্য রয়েছে। এ রোগের স্পোর সৃষ্টির আগেই মৃত প্রাণির গোয়াল ঘরকে গরম ১০ শতাংশ সোডিয়াম হাইড্রো অক্সাইড দিয়ে ধুলে জীবাণুর মৃত্যু ঘটে। তবে স্পোর সৃষ্টির সম্ভাবনা থাকলে ঘন জীবাণুনাশক পদার্থ যেমন৫ শতাংশ লাইসোল দুদিন বা ফরমালিন বা সোডিয়াম হাইড্রো অক্সাইড ৫-১০ শতাংশ অথবা পারঅ্যাসিটিক অ্যাসিড ৩ শতাংশে জীবাণুর স্পোরের বিরুদ্ধে কার্যকর। চামড়া ও পশম গামারেডিয়েশন জুতা ও প্লাস্টিকের ব্যাগ ইথাইলিন অক্সাইডে এবং দূষিত কাপড়-চোপড় ১০ শতাংশ ফরমালিনে চুবিয়ে জীবাণুমুক্ত করা যায়। এ রোগে মৃত প্রাণিকে ২ মিটার গভীর গর্তে পর্যাপ্ত কলিচুন সহযোগে মাটি চাপা দিয়ে রাখতে হবে। আক্রান্ত মৃত পশুকে মাটিতে পুঁতে ফেলার সময় পশুর নাক, মুখ, পায়ুপথ ও মলদ্বার তুলা বা কাপড় দিয়ে বন্ধ করে দিতে হবে। আক্রান্ত গরুর গোয়াল ঘর কাপড় কাচার সোডা বা ব্লিচিং পাউডার বা পটাশিয়াম-পার ম্যাঙ্গানেট দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। আক্রান্ত প্রাণিকে ভ্যাকসিন দেয়া হলে আবার ভ্যাকসিন দেয়ার প্রয়োজন নেই। তবে সুস্থ প্রাণি ভ্যাকসিন দেয়া থেকে বাদ পড়লে প্রাণিকে অবশ্যই ভ্যাকসিন দিতে হবে। গুরুত্বের সঙ্গে মনে রাখতে হবে, যেসব প্রাণি এরই মধ্যে এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে সেসব প্রাণিকে ভ্যাকসিন দিয়ে কোনো লাভ হবে না। অর্থাত্ এ রোগে প্রাণি যখনই আক্রান্ত হোক না কেন সেক্ষেত্রে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করলে কোনো লাভ হবে না। আক্রান্ত প্রাণিকে অবশ্যই সুস্থ প্রাণি ও মানুষের সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখতে হবে। এছাড়া স্থানীয় প্রাণিসম্পদ চিকিত্কদের পরামর্শ অনুযায়ী নিতে হবে।




গবাদিপশুর রোগেরবাহক আঠালী ও এর দমন ব্যবস্থা

আঠালী ক্ষুদ্রাকায় রক্তচোষা প্রাণী। গৃহপালিত ও বন্যপ্রাণীর শরীর থেকে রক্ত চুষে বেঁচে থাকার পাশাপাশি এরা বংশবিস্তার করে মারাত্মক রোগ ছড়ায়। গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, ঘোড়া, হরিণ, বাঘ, সাপ, ভাল্লুক, শিয়াল, সিংহ, হাঁস-মুরগি ইত্যাদি প্রাণীর শরীরে বহিঃপরজীবী হিসেবে আঠালী বাস করে।

 মানুষসহ অধিকাংশ প্রাণীতে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, প্রোটোজোয়া আঠালীর মাধ্যমেই ছড়িয়ে থাকে। বিশেষ করে গবাদি পশুতে বেবিসিয়োসিস, এনাপ্লাসমোসিস, থাইলেরিয়াসিস ইত্যাদি রোগের কারণ এই আঠালী। আঠালীর লালা থেকে প্যারালাইসিস বা টিক টক্সিকোসিস নামক রোগও হতে পারে। উল্লেখ্য একটি আঠালী ২৭/২৮ দিনে তার শরীরের ওজনের ৫০গুণ রক্ত শোষণ করতে পারে যার পরিমাণ প্রায় ৩ সি.সি. অর্থাত্ দৈনিক প্রায় ০.১০ সি.সি।

 আঠালী সব ঋতুতেই দেখা যায় তবে গরম ও বর্ষাকালে প্রদুর্ভার ও জন্মহার বেশি। এদের রক্ত শোষণে প্রাণীতে রক্ত শূন্যতা, চর্মরোগ দেখা দেয়। দুগ্ধবতী গাভীর দুধ অর্ধেকের নিচে নেমে আসে। চামড়ার গুণগত মান কমে যায়।

 পৃথিবীর সব দেশে আঠালী থাকলেও বাংলাদেশের সব অঞ্চলেই এদের দেখা যায়, তবে রাজশাহী, রংপুর ও দিনাজপুর অঞ্চলে বেশি।
 আঠালী দু প্রকার।
 ১. শক্ত আঠালী ও
 ২. নরম আঠালী।
 কিছু কিছু আঠালী গবাদি পশুর চামড়ার সাথে কামড় দিয়ে লেগে থাকে এবং কিছু আঠালী রক্ত খেয়ে রাতের বেলা স্যাঁতস্যাঁতে মাটি, বাঁশ অথবা পাটকাঠির বেড়ার ভাজে লুকিয়ে থাকে। শোষণকৃত রক্ত শেষ হলে কয়েক দিনের মধ্যেই আবার গরু, মহিষ, ছাগল ইত্যাদির গায়ে উঠে আবার রক্ত চোষা শুরু করে। এসময় এরা ডিম পাড়ে ও বাচ্চা দেয় যাকে বলে নিম্প। এখানে উল্লেখ্য যে, একটি স্ত্রী আঠালী প্রায় ১০০০ ডিম দিয়ে মারা যায়।

দমন ব্যবস্থা: কওমাফস (এসানল), ডায়াজিনন (নিওসিডল) নামক কীটনাশক পানির সাথে মিশিয়ে আক্রান্ত পশুর শরীর ধুয়ে দিতে হবে।

 আবার আইভার মেকটিন (আইভোমেক) ইনজেকশন চামড়ার নিচে ১ সি.সি প্রতি ৫০ কেজি ওজনের জন্য পুশ করতে হবে এবং ১৫ দিন পর একই মাত্রায় আবার দিতে হবে। অন্যান্য দেশে প্রতিষেধক টিকা দিয়ে প্রতিরোধ করা হলেও আমাদের দেশে সে ব্যবস্থা নেই। তবে কাক, বক, শালিকসহ বিভিন্ন পাখি আঠালীকে খেয়ে কিছুটা দমন করে থাকে।
 লেখক: ডা. মো. ফজলুল হক ,সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় চেয়ারম্যান
 হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর


গবাদিপশুকে কৃমি মুক্ত রাখার উপায়

বর্তমানে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গবাদিপশু পালন লাভজনক ও বেকার সমস্যা সমাধানের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হওয়ার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু আমাদের খামারিরা গবাদিপশু পালন করতে গিয়ে একটি সমস্যার সম্মুখীন হয়, তা হলো পরজীবী বা কৃমি। কৃমি এক ধরনের পরজীবী যা পশুর ওপর নির্ভর করে জীবন ধারণ করে। তারা পশুর অন্ত্রে, ফুসফুসে, লিভারে, চোখে, চামড়ায় বাস করে ও পশুর হজমকৃত খাবারে ভাগ বসিয়ে পশুর ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। অনেক কৃমি পশুর রক্ত চুষে ও আমিষ খেয়ে পশুকে দুর্বল ও স্বাস্থ্যহীন করে ফেলে।

 পরজীবী সাধারণত দুই ধরনের-
 ১. দেহের ভেতরের পরজীবী
 ২. দেহের বাইরের পরজীবী।

 একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশের প্রাণিসম্পদ হাসপাতালগুলোতে গত বছর (২০১০) বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত গবাদিপশুর (গরু, ছাগল, ভেড়া) মধ্যে ৫১.৩৬ ভাগ কৃমি বা পরজীবী দ্বারা আক্রান্ত। এর মধ্যে আক্রান্ত গরুর মধ্যে ৬৮.৯২ ভাগ, আক্রান্ত গাভীর মধ্যে ৪৫.১৬ ভাগ, বাছুরের মধ্যে ৫০.০৭ ভাগ, ভেড়ার মধ্যে ৬১.৬৬ ভাগ এবং আক্রান্ত ছাগলের মধ্যে ৩৪.৭৯ ভাগ বিভিন্ন কৃমি বা পরজীবী দ্বারা আক্রান্ত হয়। সুতরাং কৃমি বা পরজীবী আমাদের গবাদিপশু পালনের প্রধান শত্রু। কৃমি বা পরজীবীগুলো হচ্ছে কলিজাকৃমি, পাতাকৃমি, গোলকৃমি, রক্তকৃমি, ফিতাকৃমি, প্রটোজয়া ও বিভিন্ন ধরনের বহিঃপরজীবী উকুন, আঠালী, মাইট ইত্যাদি গবাদিপশুকে আক্রান্ত করে। কৃমির কারণে গাভীর দুগ্ধ উত্পাদন ক্ষমতা কমে যায় অস্বাভাবিকভাবে এবং বাছুরগুলো পেট ফুলে গিয়ে স্বাস্থ্যহীন হয়ে পড়ে। ফলে দুগ্ধ ও মাংস উত্পাদন ক্ষমতা মারাক্তকভাবে ব্যাহত হয়। এর কারণে বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ফাঙ্গাস গবাদিপশুকে আক্রান্ত করার পরিবেশ তৈরি করে।

 গবাদিপশুকে কৃমি বা পরজীবী থেকে মুক্ত রাখার উপায়গুলো হচ্ছে-
 ১) গবাদিপশুর বাসস্থানের জন্য নির্ধারিত স্থানের মাটি শুষ্ক ও আশপাশের জমি থেকে উঁচু হওয়া প্রয়োজন। সম্ভব হলে নদীনালা, খালবিল, হাওর-বাঁওড় থেকে দূরে করতে হবে।
 ২) গবাদিপশুর খামারের আশপাশে যেন বৃষ্টির পানি এবং অন্যান্য বর্জ্য জমে না থাকে ।
 ৩) খামারের জন্য নির্ধারিত স্থানের মাটিতে বালির ভাগ বেশি হওয়া প্রয়োজন যেন বর্ষাকালে খামারের মেঝে কর্দমাক্ত না হয় ।
 ৪) পশুর মলমূত্র ও আবর্জনা অল্প সময় পরপর পরিষ্কার করতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে যেন ঘরে মলমূত্র ও আবর্জনা জমা না থাকে।
 ৫) খামারের অনেক দূরে পশুর মলমূত্র ও আবর্জনা পুঁতে রাখতে হবে।
 ৬) গবাদিপশুর বাসস্থান প্রতিদিন আদর্শ ডিটারজেন্ট দিয়ে ধুয়ে এবং জীবাণুনাশক মেশানো পানি দিয়ে জীবাণুমুক্ত করতে হবে।
 ৭) তিন মাস অন্তর গবাদিপশুকে কৃমিনাশক ওষুধ খাওয়াতে হবে।

 কলিজাকৃমি, পাতাকৃমি, গোলকৃমি, রক্তকৃমি, ফিতাকৃমি দ্বারা আক্রান্ত পশুকে অ্যালবেনডাজল ইউএসপি ৬০০ মি.গ্রা., হেক্সাক্লোরোফেন ইউএসপি ১ গ্রাম, লিভামিসোল হাইড্রোক্লোরাইড বিপি ৬০০ মি.গ্রা. এবং ট্রাইক্লাবেন্ডাজল আইএনএস ৯০০ মি.গ্রা. জাতীয় ওষুধ ভালো কাজ করে। কর্কসিডিয়াতে সালফোনামাইডস, স্ট্রেপটোমাইসিন ও মেট্রোনিডাজল ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। ট্রিপানোসোমা ও ব্যাবেসিওসিস তে ব্যাবকপ খাওয়ালে রোগ ভালো হয়। উঁকুন, আঠালী ও মাইটে আক্রান্ত গবাদিপশুর শরীরে আইভারমেকটিন, সেভিন, নেগুভান ইত্যাদি ওষুধ ব্যবহার করলে ওইসব পরজীবী থেকে গবাদিপশুকে রক্ষা করা যায়। পরিশেষে আমাদের গবাদিপশুকে কৃমি বা পরজীবীমুক্ত রাখতে পারলে আমরা দুগ্ধ ও মাংস উত্পাদনের লক্ষ্যে পৌঁছাব।
 লেখক: ডা. দীপংকর দেবনাথ


গবাদি পশুর ক্ষুরা রোগ লক্ষণ ও প্রতিকার

বিভক্ত ক্ষুর বিশিষ্ট পশুর অত্যন্ত ছোঁয়াচে তীব্র প্রকৃতির ভাইরাসজনিত রোগের মধ্যে ক্ষুরারোগ অন্যতম। বাংলাদেশে গরুতে এ রোগের তীব্রতা অত্যাধিক এবং মড়ক আকারে দেখা যায়। এ ছাড়া মহিষে এ রোগের তীব্রতা কিছুটা কম। বাংলাদেশের সব ঋতুতেই ক্ষুরারোগ দেখা গেলেও সাধারণত বর্ষার শেষে এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি পরিলক্ষিত হয়।

লক্ষণ: শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়; জিহ্বা, দাঁতের মাড়ি, সম্পূর্ণ মুখ গহ্বর, পায়ের ক্ষুরের মাঝে ঘা বা ক্ষতের সৃষ্টি হয়। ক্ষত সৃষ্টির ফলে মুখ থেকে লালা ঝরে, সাদা ফেনা বের হয়। কখনোবা ওলানে ফোসকা পড়ে। পশু খোঁড়াতে থাকে এবং মুখে ঘা বা ক্ষতের কারণে খেতে কষ্ট হয়। অল্প সময়ে পশু দুর্বল হয়ে পরে। এ রোগে গর্ভবতী গাভীর প্রায়ই গর্ভপাত ঘটে। দুধালো গাভীর দুধ উত্পাদন মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়। বয়স্ক গরুর মৃত্যুহার কম হলেও আক্রান্ত বাছুরকে বাঁচিয়ে রাখা খুবই কঠিন।

করণীয়: আক্রান্ত পশুকে সুস্থ পশু থেকে আলাদা রাখতে হবে। অসুস্থ পশুর ক্ষত পটাশ বা আইওসান মিশ্রিত পানি দিয়ে ধুয়ে দিতে হবে। ফিটকিরির পানি ১০ গ্রাম (২ চা চামচ) ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে মুখ পরিষ্কার করতে হবে। সোহাগার খৈ মধু মিশিয়ে মুখের ঘায়ে প্রলেপ দিতে হবে। নরম খাবার দিতে হবে। পশুকে শুষ্ক মেঝেতে রাখতে হবে; কোনো অবস্থায়ই কাদা মাটি বা পানিতে রাখা যাবে না। সুস্থ অবস্থায় গবাদিপশুকে বছরে দুবার প্রতিষেধক টিকা দিতে হবে। খাওয়ার সোডা ৪০ গ্রাম ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে পায়ের ঘা পরিষ্কার করে সালফানাসাইড পাউডার লাগাতে হবে। সালফানাসাইড/টেট্রাসাইক্লিন অথবা উভয় ওষুধ ৫ থেকে ৭ দিন ব্যবহার করতে হবে।

রোগের বিস্তার: ক্ষুরারোগে আক্রান্ত পশুর লালা, ঘায়ের রস, মলমূত্র, দুধ ইত্যাদির মাধ্যমে এই ভাইরাস নির্গত হয়। এ ভাইরাস দ্বারা বাতাস ও খাদ্যদ্রব্য দূষিত হয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস ও খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে সংবেদনশীল পশুতে সংক্রমিত হয়। আক্রান্ত গরু ও মহিষের সংস্পর্শে এ ভাইরাস সুস্থ পশুতে সংক্রমিত হয়। আক্রান্ত পশুর ব্যবহূত দ্রব্যাদি ও পশুজাত দ্রব্যের (চামড়া, মাংস, দুধ ইত্যাদি) মাধ্যমে এ ভাইরাস একস্থান থেকে অন্যস্থানে এমনকি একদেশ থেকে অন্যদেশে ছড়িয়ে পড়ে।

প্রতিরোধে বিধিব্যবস্থা: রোগ যাতে না ছড়ায় সে জন্য আক্রান্ত পশুকে সুস্থ পশু হতে আলাদা করে চিকিত্সার ব্যবস্থা করতে হবে। রোগাক্রান্ত পশুকে শুকনো জায়গায় রাখতে হবে, কোনো অবস্থাতেই কাদাজলে রাখা যাবে না; গোয়াল ঘর বা রুগ্ন পশুর ব্যবহূত দ্রব্যাদি ১-২ % কষ্টিক সোডা (১ বা ২ গ্রাম কষ্টিক সোডা ১০০ মি. লি. পানিতে মেশাতে হবে) বা ৪% সোডিয়াম কার্বোনেট (৪ গ্রাম সোডিয়াম কার্বোনেট ১০০ মি.লি. পানিতে মেশাতে হবে) দিয়ে পরিস্কার করতে হবে; ক্ষুরারোগে মৃত পশুকে ৪/৫ পুট মাটির নিচে পুঁতে ফেলতে হবে, কোনো ক্রমেই খোলা স্থানে ফেলে রাখা যাবে না। ক্ষুরা রোগের টিকা স্থানীয় পশু হাসপাতালে পাওয়া যায় যা সময়মত দিলে ক্ষুরারোগের আক্রমণ প্রতিহত করা যায়।
 লেখক: ডা. মো. ফজলুল হক, সহযোগী অধ্যাপক মেডিসিন, সার্জারি এন্ড অবস্টেট্রিক্স বিভাগ
 হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর


গবাদি পশুর ফ্যাসিওলিয়াসিস রোগ

গবাদি পশুর যকৃতে ফ্যাসিওলা জাইগানটিকা ও ফ্যাসিওলা হেপাটিকা নামক পাতাকৃমি দ্বারা সৃষ্ট পশুর রোগকে ফ্যাসিওলিওসিস বলে। রক্তসল্পতা, ম্যান্ডিবুলের নিচে পানি জমা, যা দেখতে বোতলের মত, ডায়রিয়া এবং ধীরে ধীরে কৃশকায় অবস্থায় পরিণত হওয়াই এ রোগের বিশেষ বৈশিষ্ট্য।

রোগের বিস্তার: সুনির্দিষ্ট প্রজাতির শামুক সুনির্দিষ্ট প্রজাতির পাতাকৃমির হিসেবে কাজ করে। তাই যে সব জায়গায় এই প্রজাতির শামুক রয়েছে সেখানে ফ্যাসিওলা প্রজাতির প্রাদুর্ভাব বেশি। বাংলাদেশে ফ্যাসিওলা জাইগানটিকা পাতাকৃমির মাধ্যমিক পোষক লিমনিয়া রুফেসেন্স ও লিমনিয়া একুমিনেটা রয়েছে। ফলে আমাদের দেশে ফ্যাসিওলা জাইগানটিকা পাতাকৃমি পশুর ফ্যাসিওলিওসিস রোগের কারণ।

 গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়ায় এ রোগ হয়ে থাকে। বেশি বয়স অপেক্ষা কম বয়সের পশুতে এ কৃমিতে আক্রান্তের হার বেশি। এতে পশুর যকৃত নষ্ট হয়, প্রজনন প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটে, দুধ ও মাংস উৎপাদন কমে যায়। বাংলাদেশে প্রায় ২১ ভাগ গরুতে এবং সিলেট অঞ্চলে প্রায় ২১.৫৪ ভাগ ছাগলে ফ্যাসিওলা জাইগানটিকা পাতাকৃমিতে হয়।

রোগের লক্ষণ: ১. তীব্র যকৃত প্রদাহ এবং রক্তক্ষরণের ফলে লক্ষণ প্রকাশের আগেই পশুর হঠাৎ মৃতু্য ঘটে;
 ২. আক্রান্ত পশুর যকৃতে অপ্রাপ্তবয়ষ্ক কৃমির মাইগ্রেশনের ফলে যকৃত কলা ধ্বংস হয় এবং যকৃতিতে প্রোটিন সংশেস্নষণ হ্রাস পায়। এতে পশুর হাইপোপ্রিটিনিমিয়া তথা বটল জ্বর হয়;
 ৩. প্রতিটি কৃমির দ্বারা যকৃত প্যারেনকাইমায় রক্ত শোষণ ও ক্ষরণের কারণে প্রতিদিন প্রতিটি আক্রান্ত পশুর দেহ হতে ০.৫ হতে ১০ মিলিলিটার রক্তনাশ হয় এবং রক্তসল্পতা দেখা দেয় ও
 ৪. প্রাপ্তবয়ষ্ক কৃমি পিত্তনালীর প্রদাহ ঘটিয়ে সেখানে ফাইব্রোসিস সৃষ্টি করে। ফলে পিত্ত অন্ত্রনালীতে যেতে পারে না। তাই বদহজম ও ডাইরিয়া দেখা দেয়। ক্ষুধামন্দা ও দুর্বলতা পরিলক্ষিত হয়। চোখের কনজাংটিভা ফ্যাকাশে হয়ে যায়।

চিকিৎসা: ১. ট্রাইক্লেবেন্ডাজল বোলাস প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ১০ থেকে ১৫ মিলিগ্রাম করে আক্রান্ত পশুকে খাওয়ালে ৯০ থেকে ১০০ ভাগ সুফল পাওয়া যায়;
 ২. নাইট্রোক্সিলিন ইনজেকশন প্রতি ৫০ কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ১.৫ মিলিলিটার হিসেবে গরু, মহিষ ও ছাগলের ত্বকের নিচে প্রয়োগ করে কার্যকরী ফল পাওয়া যায়;
 ৩. সহায়ক চিকিৎসা হিসেবে দুর্বলতা ও রক্তসল্পতার জন্য ভিটামিন বি-কমপেস্নক্স ইনজেকশন দেয়া এবং মিনারেল মিকচার খাওয়ানো ভাল ও
 ৪. তীব্র পানি শূন্যতায় ইলেকট্রোলাইট সলুশন যেমন Dextrose-saline শিরায় ইনজেকশন করা যায়।

প্রতিরোধ: ১. এই কৃমির মাধ্যমিক পোষক শামুকের সংখ্যা হ্রাস করতে হবে। এক্ষেত্রে শামুক খেকো পাখি যেমন পাতিহাঁস পালন অথবা প্রতি হেক্টর জমিতে ২২.৫ কেজি করে ০.৫% কপার সালফেট অথবা হেক্টরপ্রতি জমিতে ১১.২ কেজি কপার পেন্টাক্লোরফেনেট ৪৫০০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ছিটাতে হবে;
 ২. পশুকে সন্দেহজনক স্থান যেমন নিচু জায়গা বা ড্রেনের পাশে ঘাস খাওয়ানো থেকে বিরত রাখতে হবে ও
 ৩. পশুকে ভেটেরিনারি চিকিৎসকের পরামর্শ মত কৃমিনাশক ওষুধ খাওয়াতে হবে।
 লেখক:ডা: সুমন তালুকদার (রুনু)






2 comments:

  1. একটা গরুর ওজন ৩৫০ কেজি। ৩ দিন যাবত পায়খানার রাস্তা দিয়ে প্রচুর রক্ত বাহির হইতেছে।আমি ট্রাসিড ভেট ৯০ মিলি,মারবো ভেট ২০ মিলি, রেনা কে ৩০ গ্রাম দিয়েছি।তারপরও রক্ত বন্ধ হইতেছেনা ।

    ReplyDelete
  2. ছাগলের বাচ্চা সারা দিন রোদে সুয়ে থাকে কেন,খাবার রুচি কম হয় কেন।

    ReplyDelete